রবিবার, ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এমডব্লিউইআর-আনন্দবাজার ওয়েবিনার-

পাচারের টাকায় কর্মসংস্থান

পাচারের টাকায় কর্মসংস্থান

অর্থপাচার রোধে বিনিয়োগ সহজতর করতে হবে

ড. আতিউর রহমান

দেশে বা বিদেশে বৈধভাবে আয়কারীদের ২০ শতাংশ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। অথচ ৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশে অর্জিত, পাচার করা ও কালো টাকাকে দায়মুক্তি দিয়ে দেশে আনার সুযোগের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বিদেশে অর্জিত সম্পদ দেশে আনা হলে স্থাবর সম্পত্তির জন্য ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির জন্য ১০ শতাংশ এবং নগদ অর্থ আনতে সাত শতাংশ হারে কর দিলে ওই সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে না আয়কর কর্তৃপক্ষ।’ এ বিষয়টি নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী এমনকি জাতীয় সংসদেও সমালোচনা হচ্ছে।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেন, বিদেশে পাচার করা টাকা বিনা প্রশ্নে দেশে ঢুকতে দিলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হবে। কেননা আমরা এখন অ্যান্ডমন্ড, এপিজি ও আনকাকের সদস্য। আর কস্ট ও বেনিফিট নিয়েও ভাবতে হবে। তাছাড়া এতে যে সুনাম ক্ষুণ্ন হবে তার মূল্য অপরিসীম। অর্থ পাচার রোধে তার প্রস্তাব হচ্ছে দেশে বিনিয়োগব্যবস্থা সহজ থেকে সহজতর করতে হবে।

ঢালাওভাবে দায়মুক্তি নয়, সীমারেখা বেঁধে দিতে হবে

-পরিকল্পনামন্ত্রী

মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস-এমডব্লিউইআর ও দৈনিক আনন্দবাজার আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩: পর্যালোচনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তিনি এ কথা বলেন।

এমডব্লিউইআর জাতীয় স্বপ্নবাজেটে বিদেশে পাচার করা ও দেশের ভিতরের কালো টাকা মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছিল। সেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১৬ বছরে ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসেবে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০১৮-২০১৯ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯৯ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ ফেরত এনে ও উদ্ধার করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় করতে হবে। ৫ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হলে ৭ বছরে ৩৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।

আরও পড়ুনঃ  ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাস

বিনা প্রশ্নে পাচার করা ও বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দেশের অর্থনীতির মূলস্রোতে সম্পৃক্তের প্রশ্নে সংগঠনটির বক্তব্য হচ্ছে কিছুটা দায়মুক্তি ও নির্দিষ্ট একটি সীমারেখা বেঁধে দিয়ে এসব সম্পদ মূলস্রোতে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এমনকি তাদের বাধ্য করতে হবে এসব সম্পদ দিয়ে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। আগামীতে পাচার করলে কঠিন শাস্তির মুখে পড়বে।

সম্পূরক ও সংশোধিত বাজেটের জবাবদিহিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে

-ড. আব্দুল মজিদ

সম্প্রতি একটি ওয়েবিনারে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ঢালাওভাবে এটি করলে হবে না। সাময়িকভাবে সুযোগ দেয়া যেতে পারে। পরবর্তীতে এসব কাজ করলে কঠিনতর শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে।

জাতীয় বাজেট পর্যালোচনায় ড. আতিউর রহমান বলেন, চলতি বছরটি কষ্টের, আগামী অর্থবছর আরো কঠিন হবে। তাই এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে করে মানুষ বিপদে পড়ে যায়। আমাদের উন্নতির মূল হচ্ছে কৃষি। অটোনমাস গ্রোথ যা আমাদের ভিতর থেকে আসে তা হচ্ছে কৃষি। এখানে ৪২ শতাংশ শ্রম ব্যয় হয়। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো দিক কৃষিতে যদিও জিডিপির অংশ ১২-১৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ৬৩ শতাংশ গ্রোথ আসে কনজামশন থেকে। এজন্য কৃষিতে ভতুর্কি দেয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।

ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি শারমীন রিনভী বলেন, মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা ও কমাতে হলে কৃষিখাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা প্রতিবছর মানুষ বাড়ছে, জমি কমছে। তাই কৃষিতে বরাদ্দ বেশি দেয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। যদিও এবারের বাজেটে তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ অর্থাৎ কৃষিতে ২৪ হাজার ২২৪ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ৫৬৭২ কোটি টাকা। এবার এখানে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কেননা তারা এক কেজি আলু উৎপাদনে ১২-১৩ টাকা ব্যয় করে বিক্রি করছে ৫-৬ টাকায়। ক্রেতারা কিনছে ৩০-৩৫টাকায়। মাঝখানের এই সিন্ডিকেটটি ভাঙতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  বীমায় উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ

ড. আতিউর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাংক নতুন এক আউটলুকে জানিয়েছে আগামীতে গ্লোবাল ইকোনোমিক গ্রোথ ২.৭ শতাংশ কমে যাবে ও উন্নয়নশীল দেশের গ্রোথ হবে ৪.২ শতাংশ যদিও আমাদের দেশে বর্তমানে ইকোনমিক গ্লোথ ৭ পয়েন্টের চেয়ে বেশি। কৃষিভিত্তিক ও রপ্তানিমূলক শিল্পের কারণে দেশের অর্থনীতি ভালো করছে। যেখানে ভালো করছে সেখানে আরো ভালো করার সুযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রস্তাব রাখেন তিনি। ১. কৃষিপণ্য বাজারজাত করতে ম্যাংগো ট্রেইনের মতো কিছু প্রকল্প নেয়া। অর্থাৎ ট্রেইনকে কৃষিবান্ধব করা। ২. অনলাইন-অফলাইন বাজার ব্যবস্থা বাড়ানো। ৩. কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পেতে সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, রিটার্ন জমা দেয়ার কোনো নিয়ম নেই। কেননা এটি গোপনীয় দলিল। অডিটেও সাংবিধানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থাৎ জমা দেয়ার কথা বলা যাবে না এবং করা ঠিক হবে না।
ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বিলাসবহুল পণ্য আমদানি আপাতত নিষিদ্ধ করতে হবে। রেগুলেটরি দিয়ে কমানো ঠিক না বরং কয়েক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। কাস্টম ডিউটি দিয়েও হবে না।

কালো টাকা ও বিদেশে অর্জিত টাকার সংজ্ঞাটি স্পষ্ট হওয়া দরকার। কেননা বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, বিদেশে অর্জিত টাকা। আর আমরা বুঝতেছি বিদেশে পাচার করা টাকা। প্রমাণ ছাড়া ইনটেন্সিভ দেয়া যায় না। ৫ হাজার ডলারের ক্ষেত্রে প্রমাণ তুলে দিলে বৈধপথে রেমিটেন্স আনা ও পাচারকারীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য রইলো না। ক্ষমার বিষয়টি থাকলে জনমত যাচাই করে সংসদে আইন পাস করে করতে হয়। আমাদের বাজেট বক্তৃতার সমস্যা হচ্ছে এখানে সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা দেয়া হয় না। দেশের প্রথা হচ্ছে পরবর্তী দুই মাস পরে এনবিআরের আয়কর বিভাগ আয়কর পরিপত্র জারি করার সময় তার ব্যাখ্যা দেয়। এটি না করে এখনই এটির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হোক। মানুষ বিভ্রান্তিতে আছে। কেননা অর্থবিল পাশ হয়ে গেলে এটি নিয়ে কোর্টেও যাওয়া যায় না। সাংবিধানিকভাবে নিষেধ আছে এ ব্যাপারে।

আরও পড়ুনঃ  বাজেটে জীবন-জীবিকায় জোর

মানবসম্পদ উন্নয়নে চারটি প্রস্তাব রাখেন তিনি। ১. মানবসম্পদ উন্নয়নে ইএসইআই এর কথা বলা হয় কিন্তু সুস্পষ্ট কিছু নেই। এ পর্যন্ত কত মানুষের কর্মসংস্থান করা হয়েছে তার একটি জবাবদিহি রাখতে হবে। ২. বিদেশে লোক পাঠানোতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে ও নীতিমালায় আঘাত করতে হবে। ৩. পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেখানকার মানুষজনকে প্রশিক্ষিত করতে বরাদ্দ রাখতে হবে। ৪. সম্পূরক ও সংশোধিত বাজেটের জবাবদিহি করতে হবে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। ভুলগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সাম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের নেয়া এসব প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নেও বেশকিছু সমস্যা দেখা যায় তা উৎরে উঠতে হবে। তার মধ্যে ১. সময়-সীমার মধ্যে প্রকল্প শেষ করতেই হবে। তা না হলে ব্যয় বেড়ে যায়। এতে ইন্টার্নাল রেট অফ রিটার্ন, ইকোনিক রেট অফ রিটার্ন, ফাইনান্সিয়াল রেট অফ রিটান কমে যায়। তাই এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করে দ্রুত শেষ করতে হবে। ২. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যে এলোকেশন তা কিন্তু বাড়েনি। এজন্য এসব ম্যান্টেইন্স করতে লোকবল, জনবলের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ দরকার। ৩. বেসরকারি পর্যায়েও বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি জ্বালানি বিষয়ে বলেন, জ্বালানিতে সরকার শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়েছে। ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ থেকে ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। এখন ভিন্ন দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে চারটি প্রস্তাব রাখেন তিনি। ১. ডিস্ট্রিবিউন এন্ড ট্রান্সমিশনের ব্যবস্থা রাখতে। শুধু উৎপাদন করলে হবে না সঠিকভাবে বণ্টন করতে হবে। ২. রিনিউভ্যাল এনার্জিতে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। বিন্যাসে খরচ কত তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। ৩. কুইক রেন্টাল বাদ দিতে হবে। কেননা এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ৪. সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় বিনিয়োগ করতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন