শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিনিয়োগে বাণিজ্যিক মেরুকরণ

বিনিয়োগে বাণিজ্যিক মেরুকরণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পশ্চিমা বিশ্বের যে মেরুকরণ ছিল, সম্প্রতি তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্ব এখন নতুন মেরুকরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। খাদ্য-ব্যবসা আর বাণিজ্যে নতুন নতুন জোট তৈরি হচ্ছে। অঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের স্বার্থ সংশিষ্ট বিষয়ে বোঝাপড়া বাড়ছে। আমেরিকা কেন্দ্রিক বিশ্ব এখন সিংহভাগ পণ্য উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে চীন। ফলে একধরণের ভারসাম্যের অবস্থা দেখছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও বাণিজ্য স্বার্থরক্ষায় বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ উন্নয়ন, গৃহীত নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনায় সমন্বয় সাধনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি দেশের কূটনীতির বড় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে বৈশ্বিক বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টাও থাকছে।

দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে প্রায় ১৮০ কোটির বেশি মানুষ বাস করছে। এই জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি ২৪ বছরের কম হওয়ায় ২০৪০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তরুণ জনশক্তি থাকবে দক্ষিণ এশিয়াতেই। এই সুযোগ এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত ও উৎপাদনমুখী পথে চালিত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে ‘ডেল্টা প্ল্যান- ২১০০’।

এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে প্রস্তাবিত কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (এসইপি) বা সেপা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে সরকার। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাংলাদেশ শুল্ক সুবিধা হারালেও সেপা চুক্তির মাধ্যমে আকর্ষণীয় এক সম্ভাবনার দ্বার খুলছে বাংলাদেশের সামনে। ঢাকা ও দিল্লির যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে আগামী সাত থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩-৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়বে। একই সময়ে ভারতের আয় বাড়বে ৪-১০ বিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুনঃ  ল্যাবে কোভিড-১৯ তৈরি করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা: গবেষণা

প্রস্তাবিত সেপা স্বাক্ষরিত হলে উভয় দেশের জন্য বিনিয়োগের নতুন দরজা উন্মুক্ত হবে। মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) থেকে সেপা অনেকটাই ভিন্ন। কেননা এর মধ্যে পণ্য ও পরিষেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব ও ই-কমার্সের মতো অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। গত ৩০ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো দুই দেশের যৌথ সম্ভাবনা অধ্যয়ন সমীক্ষার খসড়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ৮.৫৯৩ বিলিয়ন ডলার, যা চীনের পরই সর্বোচ্চ। একই সময়ে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ১.২৭৯ বিলিয়ন ডলার। সেপা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ মেরিন পণ্য, কাপড় ও পোশাক, ওষুধ, প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ চর্বি বা বিভিন্ন ওয়াক্স (মোম), ইনঅর্গানিক কেমিক্যালস, আটা থেকে প্রস্তুতকৃত পণ্য ইত্যাদির রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ পাবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি ভারত থেকে গম রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গত ২৩ মে বিশেষ শর্তে বাংলাদেশে ৬ লাখ টন গম রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। এবার বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সর্বনিম্ন দামে গম কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ভারতভিত্তিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাগাদিয়া ব্রাদার্স। বাংলাদেশের সরকার এখন পর্যন্ত এই প্রস্তাবটি বিবেচনায় রেখেছে। সরকারের একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, বাগাদিয়া ব্রাদার্সের প্রস্তাবের পর এ বিষয়ে ‘প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া’ পূর্ববর্তী একটি প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় বাংলাদেশ ভারতে অস্ত্র ও মাদকসহ ২৫টি পণ্য বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেলেও নন-ট্যারিফ বাধার কারণে দেশটিতে রপ্তানি বাড়ছে না। এসব নিয়েও নতুন করে হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে। আফ্রিকার বাজার ধরতে সরকারের কাছে নীতি সহায়তার দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, আফ্রিকার কৃষি ও খাদ্যপণ্যের বাজারে চীনের অবস্থান দৃঢ়। পর্যাপ্ত সম্ভাবনা থাকার পরেও যথাযথ সুযোগ ও নীতি সহায়তার অভাবে সেই বাজার ধরা যাচ্ছে না। সরকার নীতি পরিবর্তন নিয়েও চিন্তাভাবনা করছে।

আরও পড়ুনঃ  একদিনে করোনায় আক্রান্ত ৩০৯ জন মৃত ৯

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বাণিজ্য নিয়ে সংলাপ করছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটনে গতকাল উচ্চপর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপে বসেছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র। সংলাপে শ্রমিকের কর্মপরিবেশ ও ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ে আলোচনা করে দুই দেশ। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, ডিজিটাল খাতসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ও গুরুত্ব পায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, অর্থনৈতিক সংলাপে উভয় দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা চারটি সেশনে আলোচনা করেন। দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত এ ধরনের অর্থনৈতিক সংলাপ জোরদার ও সফর বিনিময়েও বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মার্কিন কৌশলগত উদ্যোগ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) বাংলাদেশ যুক্ত হলে দেশটির কাছ থেকে ঠিক কী কী ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে, সংলাপে ঢাকার পক্ষ থেকে সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়।

সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি হোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজ। সংলাপের প্রথম সেশনে তৈরি পোশাক খাতের টেকসই সরবরাহ প্রক্রিয়া, ওষুধ শিল্প, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, তুলা আমদানি, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশ, আইটি, টেলিকম ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরে বাংলাদেশ।

দ্বিতীয় সেশন শ্রমিকদের অধিকার ও শ্রম পরিবেশ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মান অনুযায়ী এ খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স ট্রেড বেনিফিট বা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা) ও ডিএফসি (ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন বা যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ আর্থিক তহবিলের সহায়তা) নিয়ে আলোচনা হয়। তৃতীয় সেশনে স্বাস্থ্য, জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তি স্থান পায়। চতুর্থ সেশন ব্লু-ইকোনমি ও মার্কিন উদ্যোগ ইন্দো-প্যাসিফিক বাংলাদেশের যুক্ততা ও সুবিধা সম্পর্কে জানতে চায় বাংলাদেশ।

আরও পড়ুনঃ  বাংলাদেশ স্মার্টফোন রপ্তানি করবে আমেরিকায়

অন্যদিকে, বাংলাদেশের কাছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এটি কীভাবে ক্রয় করা যায়, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি বা রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আমেরিকান চাপ ইউরোপ গ্রহণ করেনি। ফলে বাংলাদেশ তেল কিনবে কিনা তা নিয়েও নানা বিশ্লেষণ হচ্ছে। ফলে ভারসাম্যমূলক পরারাষ্ট্রনীতির বিষয়টিও সামনে আসছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অর্থসামাজিক খাতে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি অবশ্য একটি ইতিবাচক দিক। গত একদশকে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মাথাপিছু আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে আগামীদিন দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন