শুক্রবার, ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শতভাগ কর্মসংস্থানের প্রস্তাবনা

শতভাগ কর্মসংস্থানের প্রস্তাবনা

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশকে এখনো বেকারত্বের বোঝা বইতে হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য শতভাগ কর্মসংস্থান প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকার ‘জাতীয় স্বপ্নবাজেট ২০২২-২৩’ প্রস্তাব করছে মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস (এমডব্লিউইআর)।

সংগঠনটির দাবি ৫ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হলে ৭ বছরে ৩৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। আর ধারাবাহিকভাবে এভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলে ২০২৯ সালে বেকারমুক্ত হবে দেশ। এসব অর্থের সংস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে বিদেশে ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসেবে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০১৮-২০১৯ বছর পর্যন্ত দেশে কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯৯ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ ফেরত এনে ও উদ্ধার করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় করা সম্ভব।

মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস ও দৈনিক আনন্দবাজার আয়োজিত ‘জাতীয় স্বপ্নবাজেট: ২০২২-২৩; ‘শতভাগ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কি ধরনের বাজেট প্রয়োজন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এই বাজেট প্রস্তাব করেন এমডব্লিউইআরের আহ্বায়ক ফারুক আহমাদ আরিফ।

আরিফ বলেন, বাজেটে ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকার মধ্যে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৮ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৬.০৯ শতাংশ ও উন্নয়ন ব্যয়-১০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা অর্থাৎ ৬৩.৮০ শতাংশ। (সেখানে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকার উন্নয়ন অর্থাৎ ৩২.১০ শতাংশ এবং ৫ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় করতে হবে অর্থাৎ ৩১.৭০ শতাংশ)। পরিচালন ও উন্নয়নে মোট ব্যয় হবে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধ ২০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা অর্থাৎ ১.২৫ শতাংশ। বিশেষ ব্যয়, বিভিন্ন সংস্থার চাঁদা ও অন্যান্য ব্যয় ৬৬৫০০ কোটি টাকা। সর্বমোট ব্যয় ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৪৪০ অর্থাৎ শতাংশ ও বাজেটে উদ্বৃত্ত থাকবে ৭৮ হাজার ৫০৮ অর্থাৎ ৫.০২ শতাংশ।

বাজেটে আয়ের খাত সম্পর্কে বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করসমূহ হতে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫০.৮০ শতাংশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত করসমূহ হতে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা অর্থাৎ ১০.৫৬ শতাংশ ও কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩৮.৬৩ শতাংশ । মোট ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা।

আরও পড়ুনঃ  জনমানব শূন্য ২০ গ্রাম

২০১৮ সালের বিবিএসের প্রতিবেদন উল্লেখ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রস্তবনায় বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এরমধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে অর্থাৎ বেকার। প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসে কিন্তু চাকরি পায় মাত্র ৭ লাখ বাকি ১৫ লাখ বেকার থাকে। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২০ নং অনুচ্ছেদে অধিকার ও কর্তব্যরুপে কর্ম শীর্ষক (ক) অধ্যায়ে বলা হয়েছে: “কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী”-এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন। (খ) রাষ্ট্র এমন অবস্থার সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক-সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।”

সে লক্ষ্যে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে এবং বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয় নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ২৩ লাখ। সমুদ্রবিষয়ক, মৎস ও প্রাণিসম্পদ, নৌপরিবহন, পরিবেশও বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ১৭ লাখ। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৫ লাখ। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ১০ লাখ। স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রণালয় ৭ লাখ। অর্থ মন্ত্রণালয় ৩ লাখ। আইসিটি মন্ত্রণালয় ৩ লাখ। শিল্প মন্ত্রণালয় ২ লাখ ও বাকি মন্ত্রণালয়গুলো মিলে ৫ লাখসহ মোট ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ২০২৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৭ বছর ধারাবাহিকভাবে এ কাজ করলে দেশের সকল শিক্ষিত-ঝরেপড়া-নিরক্ষর মানুষের শতভাগ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারবে রাষ্ট্র।

আরিফ বলেন, এক্ষেত্রে মাত্র ৫ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। যেমন, মাস্টার্স পাস করা ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে ৮ লাখ করে ৮০ হাজার কোটি, অনার্স পাস ২০ লাখকে ৭ লাখ করে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, এইচএসসি পাস ৩০ লাখকে ৫ লাখ করে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি ও এসএসসির ৩০ লাখকে ৩ লাখ করে ৯০ হাজার কোটি টাকা ও অষ্টম শ্রেণি ২০ লাখকে ৩ লাখ করে ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিলে এই অর্থের প্রয়োজন। এদেরকে ৬ বছরের জন্য ঋণ দেবে তার মধ্যে দ্বিতীয় বছর থেকে পরিশোধ শুরু হবে।

আরও পড়ুনঃ  বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বড় বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখছে বেপজা

ঋণ-পরিশোধ সম্পর্কে বলেন, ঋণ-পরিশোধে মাস্টার্স ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিবে, সেখানে তাকে প্রতিমাসে ১৪ হাজার ৮৩৩ টাকা, অনার্স ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেবে, তাতে ১২ হাজার ৫০০ টাকা, এইচএসসি ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেবে, তাতে ৮ হাজার ৮৩৩ টাকা, এসএসসি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা ও অষ্টম শ্রেণি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দেবে, তাতে তাদেরকে ৫ হাজার ৩৩৩ টাকা করে প্রতিমাসে পরিশোধ করতে হবে। এভাবে ৫ বছর অর্থায়ন করলে দেশে শিক্ষিত ও ঝরেপড়া শিক্ষিতদের শতভাগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বছরে ফেরত আসবে মাস্টার্সে ১৭ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা, অনার্সে ৩০ হাজার কোটি টাকা, এইচএসসিতে ৩১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা, এসএসসিতে ১৯ হাজার ১৯৮ ও অষ্টম শ্রেণিতে ১২ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকাসহ মোট ১ লাখ ১১ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।

এমডব্লিউইআরের আহ্বায়ক বলেন, জাতীয় বাজেটের ন্যায় ১৭টি বিভাগে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের মধ্যে রয়েছে ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা পরিচালন ও উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে জনপ্রশাসনে ১ লাখ ৩২ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৮.৪৬ শতাংশ, পরিচালন ব্যয় ৪৩ হাজার ১০০ ও উন্নয়ন ব্যয় ৮৯ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে ১ লাখ ১ হাজার ৫ কোটি টাকা যা জিডিপির ৬.৪৬ শতাংশ, পরিচালন ৪১ হাজার ৫০০ ও উন্নয়ন ৫৯ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। প্রতিরক্ষায় ৩৪ হাজার ৫০৬, জিডিপির ২.২০ এবং পরিচালন ১৫ হাজার ৬৫৬ ও উন্নয়ন ১৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুনঃ  হাওরে এখনও ৬৫ ভাগ ধান কাটা বাকি

জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪১৬০০, জিডিপির ২.৬৬ শতাংশ, পরিচালন ১৫৪৮০ ও উন্নয়ন ২৬১২০ কোটি টাকা। শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩০০, জিডিপির ২১.৯৮ শতাংশ, পরিচালন ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ ও উন্নয়ন ১ লাখ ৮৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যে ১ লাখ ১০০, জিডিপির ৬.৪১ শতাংশ, পরিচালন ৪৯০৫৮ ও উন্নয়ন ৫১০৪২ কোটি টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ৩২৭৫৬, জিডিপির ২.০৯ শতাংশ, পরিচালন ১৬০৭৮ ও উন্নয়ন ১৬ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। গৃহায়নে ১৭৪১০ কোটি টাকা, জিডিপির ১.১১ শতাংশ, পরিচালন ৩০১০ ও উন্নয়ন ৪৪০০ কোটি টাকা।

কৃষিতে ৩৭০৪১২কোটি টাকা, জিডিপির ২৩.৭২ শতাংশ, পরিচালন ৭০০৭৭ ও উন্নয়ন ৩ লাখ ৩৩৩৫ কোটি টাকা। সংস্কৃতি ও ধর্ম, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৩কোটি টাকা, জিডিপির ১০.০৪ শতাংশ, পরিচালন ৩৩ হাজার ৪০১ ও উন্নয়ন ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ৫৪ হাজার ৫৫০, জিডিপির ৩.৪৯ শতাংশ, পরিচালন ২৫২৭৪ ও উন্নয়ন ২৯২৭৬ কোটি টাকা। শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে ২ লাখ ৬ হাজার ৫৪৫, জিডিপির ১৩.২২ শতাংশ, পরিচালন ৪০ হাজার ১১১ ও উন্নয়ন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। পরিবহন ও যোগাযোগে ৯০ হাজার ৭৬৬, জিডিপির ৬.৪৫ শতাংশ, পরিচালন ৩৪৭৬ উন্নয়ন ৯৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকা।

তা ছাড়া ঋণ পরিশোধে ২০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা অর্থাৎ ১.৩১ শতাংশ। বিভিন্ন সংস্থার চাঁদা বাবদ ১০৫০২ কোটি টাকা, ১.৬৩ শতাংশ। অন্যান্য ব্যয়: ১৩ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, ০.৮৫ শতাংশ। পেনশন হিসেবে ২২ হাজার কোটি টাকা, ১.৪০ শতাংশ। বিশেষ ব্যয়: ২০ হাজার ৭৫, ১.২৮ শতাংশ (সবমিলে ৪.২১)। সঞ্চয় বা উদ্বৃত্ত থাকবে ৩৮ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা অর্থাৎ ২.৪৬ শতাংশ। বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। সেখানে মূল্যস্ফীতি: ৫ দশমিক ৩ শতাংশ ও ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়ের সীমা হচ্ছে বার্ষিক ৫ লাখ টাকা বলে প্রস্তাব করেন তিনি।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন