করোনা মহামারির ভয়াবহ ধাক্কায় গেল দুই বছরে বিশ্ব অর্থনীতি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু জাতীয় ক্ষেত্রে নয়, বিশ্বজুড়েই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য একেবারেই থমকে যায়। অর্থনৈতিক মন্দা দেশে দেশে আছড়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বলা যায় অনেকটা ধসেই পড়ে দেশের রপ্তানিখাত। তবে করোনা তাণ্ডব খানিকটা কমে আসায় আবার যখন দেশের রপ্তানিখাতে সুবাতাস দেখা দেয়, তখনই আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এতে বৈশ্বিক রপ্তানিখাতে মন্দা হওয়া বইতে শুরু করে। সেই যুদ্ধের অস্থিরতায় দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও।
তবে সবকিছু সামলে অবিশ্বাস্যভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের রপ্তানিখাত। রপ্তানিকারকরা একের পর এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছেন। দেশের পণ্য রপ্তানি আয়ে বইছে স্বস্তির সুবাতাস। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতি ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। যদিও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। রপ্তানিকারক ও ইপিবির কর্মকর্তারা আশা করছেন, চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পণ্য রপ্তানি ৭ বিলিয়ন ডলার বাড়বে। এই ধারা অব্যাহতভাবে চললে অর্থবছর শেষে পণ্য রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে।
করোনা মহামারির তাণ্ডবের পর চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য রপ্তানিতে ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। তাতে দুই মাস বাকি থাকতেই চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি রপ্তানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১০ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। এর আগে এক বছরে সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাকের (আরএমজি) পাশাপাশি রপ্তানি বেড়েছে হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রকৌশল ও রাসায়নিক পণ্যের। তবে বড় খাতের মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে। আর রপ্তানিতে এবারও শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে তৈরি পোশাক।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১০ মাসে ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি ডলারের। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই খাত থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। শুধু এপ্রিলে রপ্তানি হয়েছে ৩৯৩ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৫৬ শতাংশের মতো। গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৫১ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছে ৪০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থবছরের হিসাবে আয় হয়েছে ১০ মাসে ৪৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়েও ১২ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, সরকার আরএমজি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ বিলিয়ন ডলার ঠিক করলেও আমরা আশা করছি তা ৪৩ বিলিয়ন ডলার ক্রস করবে। বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাই আগামী বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে ক্রয়াদেশের হার কিছুটা পড়তির দিকে। আগামী জুন-জুলাই থেকেই রপ্তানি আয়ে তা প্রকাশ পাবে। রপ্তানি ধরে রাখতে উদ্যোক্তাদের নতুন উদ্যোগ লাগবে।
এদিকে, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকার ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এ কারণে এ খাতের রপ্তানিও বাড়ছে। বিশ্বের যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন, সেসব দেশেই এসব পণ্য বেশি রপ্তানি হয়। চলতি অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ওয়েল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, এ খাতে রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকার ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এ কারণে এ খাতের রপ্তানিও বাড়ছে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কিছু দেশেও বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। নতুন নতুন দেশে রপ্তানি যত বাড়বে, এ খাতের সম্ভাবনাও তত বাড়বে।
তবে এদিকে রপ্তানি আয়ের লক্ষমাত্রা অর্জন হয়নি পাট ও পাটজাত পণ্যের। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১১৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৯৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। আয় কম হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পাশাপাশি গত বছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বলেন, চলতি অর্থবছর পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। আমরা আশা করছি এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রপ্তানি হবে। যা ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারে। এর সঙ্গে সার্ভিস রপ্তানি আরো ৮ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হলে চলতি বছর বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ৫৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট মন্দার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা প্রায় ৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার সাময়িক ভাবে বাতিল অথবা স্থগিত রেখেছিল। সেসব অর্ডারের বিপরীতে মূল্য পরিশোধের সমন্বয় থেকে গেল বছরের অক্টোবরের আয়ের একটি বড় অংশ দেশে আসে। তাছাড়া গেল বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে ৪ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে, যেটি এক মাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। যার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তৈরি পোশাক খাতের। যে খাত থেকে দেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশই আসে। চলতি অর্থবছরে আবারো চাঙ্গা হয়েছে পোশাকখাতের রপ্তানি।
আনন্দবাজার/শহক