শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাতের জন্যই ধানচাষ

ভাতের-জন্যই-ধানচাষ-dainikanandabazar

দেশের প্রধান খাদ্য ভাত। আর সেই ভাতের উৎস হচ্ছে ধান। ধানচাষিরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন ধানের আবাদে কোনো লাভ হচ্ছে না। সারাবছর ঘরের খাবারের নিশ্চয়তাতেই ধানচাষ করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে লাভ তো দূরের কথা, খরচও অনেক সময় উঠে আসছে না। আবার দিন দিন এমন অবস্থা হয়েছে, ধানের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে।

একদিকে সেচ, সারের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে বেশি টাকা মজুরিতেও মিলছে না শ্রমিক। গ্রামের বেশিরভাগ শ্রমজীবী চলে গেছে শহরে। নানা ধরনের কাজ খুঁজে নিয়েছে তারা। চাষিরা বলছেন, কৃষিকাজে চাষির লাভের চেয়ে শ্রমিকের মজুরি বেশি। তরুণশ্রমজীবীদের কৃষিকাজে শ্রম বিক্রিতে অনীহা তৈরি হয়েছে। তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে যেকোনো কাজের সন্ধানে ব্যস্ত। শুধু প্রবীণ কিছু ব্যক্তি এই শ্রমে নিয়োজিত।

তা ছাড়া পাল্টে গেছে শ্রমের সময়। আবহমানকাল হতে ভোর হতে সন্ধ্যা অবধি চলতো কৃষিশ্রম। বর্তমানে সকাল ৮টা হতে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টা চলে কাজ। অথচ সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত যে পরিমাণ কাজ হয় তা সারাদিনের তিন ভাগের দুই ভাগের সমান। শ্রমের সময় পাল্টে যাওয়াতেও কাজে শ্রমিক বেশি লাগছে।

ময়মনসিংহের ধানচাষিরা বলছেন, বর্তমানে এক কাঠা জমিতে ধান উৎপাদন হচ্ছে তিন থেকে ৫ মণ পর্যন্ত। বেশিরভাগ জমিতে তিন মণ ধানের বেশি পাওয়া যায় না। যার বাজার মূল্য আড়াই হাজার টাকার মতো। অথচ এই তিনমণ ধান উৎপাদন ব্যয় হয় প্রায় ৪ হাজার টাকা।

ময়মনসিংহের ত্রিশালের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল নুরুল্লাহ ব্যবসার পাশাপাশি কয়েক কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তিনি বলেন, কৃষিকাজে লাভ নেই। কেননা এক কাঠায় ধান উৎপাদন করতে বীজ, সার, বপন, চারা রোপন, নিড়ানি, কীটনাশক বাবদ যে ব্যয় হয় তার ওপর চেপে বসেছে বাড়তি শ্রমিক খরচ। প্রতিদিন শ্রমিক খরচ নগদ ১২০০ টাকার সঙ্গে তিনবেলা খাবার, ধান মাড়াইয়ের বাড়তি খরচ যোগ করলে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বীজবপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত চার মাসের বেশি সময় ধরে চাষিরা নিজেও শ্রম দেন। অথচ ধানের বাজার মূল্য অনুযায়ী কাঠাপ্রতি চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে দেড় হাজারের বেশি টাকা।

আরও পড়ুনঃ  আদমদীঘি বাজারে পিরানহা জব্দ

হাওরের চাষিদের দেয়া হিসাব মতে, এক বিঘায় সর্বাধিক ৬০ মণ ধান উৎপাদন করতে ব্যয় হয় প্রায় লাখ টাকা। অথচ সেই ধান বিক্রি করে চাষিদের ঘরে আসে ৬৮ হাজার টাকা মতো। সে হিসেবে বিঘাপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩২ হাজার টাকা করে।

ফিশারিতে ধান চাষ করেছেন চাষি সোহাগ শ্রমিক না পেয়ে নিজেই কাটছেন। সোহাগ বলেন, মাছচাষ শেষে বোরো মৌসুমে অনেকে ধানচাষ করেন। এতে সার কম লাগে। তবে এবার ধান কাটতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন সোহাগের মতো চাষিরা। শ্রমিকের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে ধান চাষে। তিনি বলেন, ময়মনসিংহ জেলার বেশিরভাগ জমিতেই এখন মাছচাষ হচ্ছে। বোরো মৌসুমে এসব ফিশারিতে ধান চাষ করা হয়ে থাকে। এতে ফিশারির খরচ কমে আসে।

ময়মনসিংহের সাধারণত জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও শেরপুর থেকে ধান কাটার শ্রমিকরা আসেন। তারা ভাটি অঞ্চলের লোক বা ভাইট্যা কামলা নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। এই ভাইট্যা কামলা থাকলে ব্যয় কিছুটা কম। তবে চলতি বোরো মৌসুমে পর্যাপ্তসংখ্যক কাজের লোক না আসায় শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। এমনিতে স্থানীয়ভাবে কৃষিশ্রমিক কম। ফলে কৃষককে প্রচুর অর্থব্যয় করে শ্রমিক নিতে হচ্ছে। যা গিয়ে চাপ বাড়াচ্ছে ধানের উৎপাদন খরচে।

ধানচাষি ওসমান বলেন, পানি সেচ কম লাগায় আউশ ও আমন চাষে ব্যয় কম। সে সময় শ্রমিকের দামও থাকে কম থাকে। তিনি মনে করেন, ধানের দাম মণপ্রতি ১২০০ টাকা হলে খরচ বাদে কিছু লাভ হতো। সাতশ বা আটশ টাকায় ধান বিক্রি করে কোনো লাভ হয় না। বরং লোকসান হয়। এমদাদুল হক নামে এক তরুণ চাষি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আসলে খালি ধানচাষই নয়, কৃষিকাজে কোনো লাভ দেখতে পাচ্ছি না। সারাবছরের খাবারের দরকার না হলে ধান চাষ কেউ করতো না।

আরও পড়ুনঃ  ঢাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা

ময়মনসিংহ কৃষি খামারবাড়ির হিসাব মতে, চলতি মৌসুমে জেলায় দুই লাখ ৫৯ হাজার ৮৪২ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ লাখ ২৫০ টন। ফলন ভালো হলেও, ধানের ন্যায্যমূল্য নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কৃষক।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেন ২৭ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা এবং আতপ চাল ৩৯ টাকা করে। সে হিসেবে এক মণ ধানের দাম দাঁড়ায় এক হাজার ৮০ টাকা। তবে বাজারে এই দামে কোনো ধান নেই। কৃষক পর্যায়ে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ২০ টাকা কেজিতে। সাতশ থেকে আটশ টাকা মণে।

চাষিরা বলছেন, তারা চলতি মৌসুমের ধান বিক্রি করেই সারাবছরের ব্যয় নির্বাহ করেন। তবে উৎপাদন মৌসুমে দাম কম থাকায় তারা লোকসানে পড়েন। ফসলের উৎপাদন মৌসুমে যাতে বাজার স্থিতিশীল থাকে সে ব্যবস্থা নিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন