শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাসবাণিজ্যের বিকল্পে শঙ্কা

বাসবাণিজ্যের বিকল্পে শঙ্কা বাইক

দিনে-রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে, যুদ্ধ করেও মিলছিল না ট্রেনের টিকিট। বাসেও কালোবাজারির কারণে ভাড়া দ্বিগুণ, তিনগুণ হাঁকা হচ্ছিল। বাড়ি যাওয়ার টিকিট জোগার করতে সীমাহীন ভোগান্তি আর সময় খরচ আর কত করা যায়? বিমানেও তো সব এলাকায় যাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে চরম ঝুঁকি জেনেও নিজের মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাড়ি যেতে যে কষ্ট হয়নি তা বলবো না। তবে স্বাধীনভাবে গেছি, আবার ফিরেও এসেছি…। এভাবেই বলছিলেন মোটরসাইকেলে গ্রামের বাড়িতে ঈদের ছুটি কাটিয়ে রাজধানীতে ফেরা উত্তরাঞ্চলের জেলা বগুড়ার সোনাতলার তরুণ আমিনুল ইসলাম।

ঈদের ছুটি কাটিয়ে মোটরসাইকেলে উত্তরাঞ্চল থেকে পরিবারসহ ঢাকায় ফেরা আরেক তরুণ মোরশেদ বললেন, প‌রিবার নি‌য়ে বা‌ড়ি যাওয়ার সময় যখন ক্লান্তি লেগেছে তখন রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে বসে বিশ্রাম নিয়েছি। এটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। ট্রেনের তো টিকিটই কাটতে পারিনি। তাছাড়া বাসেও তো ঝুঁকি কম নয়। তবে ভালোয় ভালোয় কর্মস্থলে ফিরেছি- এটাই বড় কথা।

দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানীতে ফিরে আসা চাকরিজীবী পলাশ জানালেন, কী আর করা জীবনের ঝুঁকি জেনেও স্ত্রী-সন্তানকে বাইকে নিয়েই প্রিয় মানুষদের সঙ্গে গ্রামে তবে খুব সহজেই যেতে পারছি। বরং অনেকটা আনন্দ করতে করতেই বাড়ি গেছি। কোথাও কারো ওপর যেমন নির্ভর করতে হয়নি, তেমনি টাকা পয়সাও সাশ্রয় হয়েছে।

তরুণ আমিনুল, মোরশেদ কিংবা চাকরিজীবী পলাশের মতো হাজার হাজার মানুষের এবারের ঈদযাত্রা ছিল একেবারেই ভিন্ন। গণপরিবহন, ট্রেন কিংবা বিমানের টিকিটের জন্য তারা চরম ভোগান্তির পথে আর যাননি। নিজের বাইকের ওপর ভরসা করে চরম ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি গেছেন। আবার ফিরেও এসেছেন রাজধানীতে। তাদের এই বাইকযাত্রাই এবারের চিরচেনা ঈদযাত্রাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

বাসস্ট্যান্ডগুলোর আশপাশে দেখা গেছে মোটরসাইকেল রাইডারদের ব্যাপক ভিড়। সড়ক, মহাসড়ক, ব্রিজ ও ফেরিঘাটে মোটরসাইকেলের বিশাল মিছিল সবার নজর কেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দেখা গেছে। তবে শুধু বাইকই নয়, অন্য অনেক বিকল্প উপায়েও অনেকে বাড়ি গেছেন। অভিজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে ভাড়া আর ভোগান্তির নৈরাজ্যে মানুষ বিকল্প পরিবহনের সন্ধান করেছে। এর মধ্যে অন্যতম মোটরসাইকেল। তবে বিকল্প হিসেবে মোটরবাইক অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে মহাসড়ক বা হাইওয়েতে বাইক চালানোয় দুর্ঘটনার ঝুঁকিমাত্রা বেশি।

আরও পড়ুনঃ  বেইলি রোডের আগুনে ৪৩ জনের মৃত্যু : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

বাংলা‌দেশ সেতু কর্তৃপক্ষের বঙ্গবন্ধু সেতুর কর্মকর্তাদের মতে, সেতুর টো‌লের ইতিহা‌সে এবারই প্রথম স‌র্বোচ্চ সংখ‌্যক মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু সেতু দি‌য়ে পারাপার হ‌য়ে‌ছে‌। বে‌শি পারাপারের কারণে সেতুর পা‌শেই মোটরসাইকেলের জন‌্য দুটি অস্থায়ী টোলবুথ চালু করা হয়। টোল প্লাজার তথ্যমতে, ২৫ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত সাতদিনে প্রায় ৩৫ হাজার মোটরসাইকেল পারাপার হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে। অন্যদিকে, শিমুলিয়া ফেরিঘাটে প্রায় ১১ হাজার, পাটুরিয়া ফেরিঘাটে ১১ হাজারের বেশি, কাঁচপুর সেতু দিয়ে ১০ হাজারের বেশি বাইক পারাপার হয়েছে। এর বাইরে হানিফ ফ্লাইওভার, মেঘনা-গোমতী সেতু ছাড়াও বাইকযাত্রীরা ঢাকা থেকে নানাপথে বের হয়ে আশপাশের জেলাগুলোতে যাতায়াত করেছে। হিসাব মতে, এভাবে প্রায় এক কোটি ট্রিপ হয়েছে মোটরবাইকের।

তবে বাইকনির্ভর এই ঈদযাত্রার কারণে চরম যাত্রীসংকটে পড়তে হয়েছে গণপরিবহন তথা দূরপাল্লার বাসগুলোকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, মালিকদের লাগামহীন মুনাফার লোভ, ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক আর যানজটের চরম ভোগান্তি এড়াতেই এমনটা ঘটেছে। বাইকনির্ভর ঈদযাত্রাকে অনেকেই গণপরিবহণে ভাড়াবাণিজ্য আর চরম নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহণের লাগামহীন ভাড়ার কারণে মানুষের মনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, এই ঘটনা তার বহিঃপ্রকাশ। তবে বাইকে করে যে ঝুঁকিপূর্ণ ঈদযাত্রা সেটা কোনোভাবেই গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ৪০ লাখ যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য ছিল বাস মালিকদের। তবে সে লক্ষ্য আলোর মুখ দেখেনি। বাস মালিকরা প্রস্তুত থাকলেও ঈদের আগের দুদিন অনেক বাস টার্মিনাল থেকে বেরই করা হয়নি। সেই চিত্রের উল্টোর ঘটনা চোখে পড়েছে ফেরিঘাট ও বিভিন্ন টোলপ্লাজায়। মোটরসাইকেলের জন্য করতে হয়েছে ফেরির ব্যবস্থা। টোলপ্লাজায় করতে হয়েছে আলাদা লাইন।

বাংলাদেশে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, গত দুই বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে নতুন ১০ লাখ মোটরসাইকেল যুক্ত হয়েছে। এতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৪০ লাখে। এই সংখ্যা প্রতিনিই বাড়ছে। এবারের ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলে করে গ্রামে গিয়েছে এক কোটি ট্রিপ। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বাসের ভোগান্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া। করোনায় অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মধ্যে অতিরিক্ত ভাড়া মানুষকে বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করেছে। বিগত সময়ে মানুষ বিকল্প খুঁজে না পাওয়ায় বাস মালিকদের সব অন্যায়-অত্যাচার মেনে নিয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া সত্ত্বেও মানুষকে গ্রামে যেতে হয়েছে বাসে করে। তবে এবার বিকল্প হিসেবে মোটরসাইকেলে উৎসাহিত হয়েছে ঘরমুখো মানুষ।

আরও পড়ুনঃ  দরপতনে ৭০ ভাগ প্রতিষ্ঠান

অবশ্য রাজধানীতে বছরের পর বছর অসহনীয় যানজটের কবলে পড়ে সহজ যাতায়াতের জন্য কর্মজীবী মানুষ ক্রমেই মোটরবাইকের দিকে ঝুঁকছেন। করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকে ফেরিঘাটে মোটরসাইকেল নিয়ে পার হওয়া যাত্রীদের সংখ্যা বাড়তে দেখা গেছে। ঘাটগুলোতে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র মোটরসাইকেল পার করার জন্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবার মোটরসাইকেল ঈদযাত্রায় স্বস্তি আনতে ভূমিকা রাখলেও দূরপাল্লার জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ। গত করোনার দুই বছর ঈদের সময় দূরের যাত্রায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার নজরে আসে। এবারের ঈদে তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ঈদ যাত্রার চেনা চিত্রই বদলে দেয় মোটরসাইকেল।

অতি মুনাফার পরিকল্পনা করতে গিয়ে এবার গণপরিবহন তাদের কাঙ্ক্ষিত যাত্রী পায়নি বলে মনে করছেন অনেকেই। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের অভিযোগ, যাত্রী না থাকায় ঈদের আগের দুদিন টার্মিনালেই বসে ছিল অনেক বাস। কিছু বাস চলেছে কম যাত্রী নিয়ে। বাসবাণিজ্যে এমন নাজুক পরিস্থিতির জন্য মালিকরা মোটরসাইকেলের বিপুল ব্যবহারকেই দুষছেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বাস মালিকদের এবারের ঈদ কেটেছে সংকটে। ঈদে ২০ লাখের বেশি মানুষ মোটরসাইকেলে করে ঢাকা ছেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কেউ পরিবহনখাতে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। উল্টো যারা এইখাতে যুক্ত আছেন তারাও ব্যবসা ছেড়ে চলে যাবেন। আমাদের ৪০ লাখ যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা থাকলেও ঈদের আগের দুদিন যাত্রীই ছিল না। ছুটি লম্বা হওয়ায় অনেকেই তাদের পরিবার আগে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। পরে তারা মোটরসাইকেলে চলে গেছে। বাস মালিকরা বলছেন, এভাবে গণপরিবহন হিসেবে মোটরসাইকেলের ব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না।

তবে সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, বাস মালিকদের উচিৎ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করার পাশাপাশি সব ধরণের যাত্রী হয়রানি বন্ধ করা। তারা যদি যাত্রী হয়রানি বন্ধ না করেন তাহলে মানুষ মোটরসাইকেলে আরও বেশি উৎসাহিত হবে। এতে করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবহন খাত। সেজন্য অন্যের দিকে আঙ্গুল না তুলে নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করতে হবে। যাত্রী সেবার মান বাড়াতে হবে। তা না হলেও ভুক্তভোগীরা আরো বিকল্প পথ বের করবে।

আরও পড়ুনঃ  ডলার বন্ডে সীমাহীন সুযোগ

‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন দাবি করছেন, গত এক যুগে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা পাঁচ গুণ বেড়েছে। তার মতে, মোটরসাইকেল হাইওয়েতে চলার যান নয়। ঝুঁকিপূর্ণ বাইক মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়াবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঈদের আগে ও পরে মিলে (২৫ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত) সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৭৮টি। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৩৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৯ প্রাণহানির মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহীর সংখ্যা ৯৭ জন। এর মধ্যে ৫১ জনের বয়স ছিল ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তথ্য বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৫৭ শতাংশ ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। যদিও সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ মে থেকে ৫ মে পর্যন্ত। এই সংখ্যা ১১২টি। যেখানে প্রাণহানি ১৩৯। এ সময়ে ৫৬ জন মোটরসাইকেল আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন। যা মোট মৃত্যুর ৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেছেন, দূরপাল্লায় যাত্রায় মোটরসাইকেল ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এবার অনেক মোটরসাইকেল বাণিজ্যিকভাবে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন করেছে। যা দেশের বিদ্যমান রাইড শেয়ারিং নীতিমালার পরিপন্থী। তিনি মনে করেন মোটরসাইকেল গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৮৮টি। ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৮১৭টি। তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলে প্রায় ৫০ লাখ মোটরসাইকেল আছে। অর্থাৎ দিন দিন মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছেই। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। শুধু গণপরিবহনে সঠিক ব্যবস্থাপনা আর ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে ব্যর্থতার কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেল ব্যবহার বাড়ছে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন