শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছেই

রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছেই

দেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সাতক্ষীরা জেলার অত্যন্ত সম্ভাবনাময় রাজস্বকেন্দ্র ভোমরা স্থলবন্দর। তবে বন্দরটির রাজস্ব আদায়ের ঘাটতির পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল তাও অর্জিত হয়নি। বছরের প্রথম দুই মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৬৯ কোটি টাকায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ভোমরা স্থলবন্দর রাজস্ব ঘাটতির বহুমুখী কারণের মধ্যে অন্যতম সি এন্ড এফ অ্যাসোসিয়েশন। তাছাড়া বন্দরে জায়গা অপ্রতুল, ফলসহ বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানি না হওয়া, শ্রমিক অসন্তোষ ও বেনাপোল বন্দর ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা, যাতায়াত ব্যবস্থার অবনতি, ওয়ারহাউজ ছোট হওয়া, প্রবেশদ্বার ও বাহির হওয়ার পথ অপ্রশস্ততাসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে। তবে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের অভিযোগের তীর মধ্যস্বত্বভোগীদের দিকে। বিশেষ করে, ভোমরা স্থলবন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী ও সি এন্ড এফ অ্যাসোসিয়েশনকে দায়ী করছেন তারা।

ভোমরা স্থলবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দর ব্যবহারকারীরা নিয়ন্ত্রণ করে ভোমরার আয় ও ব্যয়। আমাদের দায়িত্ব কেবল রাজস্ব আদায় করা। তবে নানাবিধ কারণে অন্যান্য অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ অনেকটা কমেছে।

ভোমরা কাস্টমসের সহকারী কমিশনার আমির মামুন বলেন, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৩ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৫৯ দশমিক ২০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ঘাটতি ৩৪ দশমিক ২৫ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা থাকলেও আদায় হয়েছে মাত্র ৬২ দশমিক ৪১ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল ৭ দশমিক ৪৪ কোটি টাকা।

আরও পড়ুনঃ  চামড়া ক্রয়ে ৬৮০ কোটি টাকার ঋণ বরাদ্দ

রাজস্ব ঘাটতি সম্পর্কে ভোমরা কাস্টমসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বেনাপোল ও সোনামসজিদসহ অন্যান্য স্থলবন্দরে সিএন্ডএফ ও আমদানিকারকদের যে ধরনের সুবিধা দেয়া হয় এখানে সেটা হয় না। সে কারণে তারা বেনাপোল ও সোনামসজিদ বন্দর ব্যবহার করছেন। অন্যান্য সুবিধা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ফল আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা ওজনের ছাড় দেওয়ার দাবি করেন। আমরা সেটা করি না বিধায় তারা যে বন্দরে এখন সুবিধা পান সেখানেই যান। তাই এ বন্দর দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ফল আমদানি হচ্ছে না। আমদানি হচ্ছে গম, যার কোনো শুল্ক নেই। ভূষিতেও আমদানি শুল্ক কম।

ভোমরা কাস্টমসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট আরো বলেন, ভোমরা বন্দর দিয়ে আনা পাথর ছাড়া অন্যকোনো পণ্যে শুল্ক তেমন একটা আদায় হচ্ছে না। মাছ রপ্তানি একেবারে নেই বললেই চলে। তাছাড়া জায়গার অভাবে পণ্য খালাস, গাড়ি পার্কিং নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অসহযোগিতার কারণে রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে।

বন্দর ব্যবসায়ী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও সাইফুল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী নাজমুল আলম মিলন জানান, বর্তমানে সি এন্ড এফ অ্যাসোসিয়েশনের যারা কর্ণধার, তাদের কোনো ব্যবসা নেই। কেবল ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে অনির্বাচিতভাবে চেয়ার দখল করে বসে আছেন। তাদের অসদাচরণ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছেন না। ভোমরা বন্দর একটি সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর। কতিপয় লোকের কারণে বন্দরটি রাজস্ব হারাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেনাপোল বন্দরের কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী। তারা চান না ভোমরা বন্দরের ব্যবসায়ীদের উন্নতি হোক।

আরও পড়ুনঃ  কৃষি-মৎস্যখাতে অপার সম্ভাবনা

ভারতের কলকাতা থেকে ভোমরা স্থলবন্দরের দূরত্ব বেনাপোল বন্দরের চেয়ে অনেক কম। এ কারণে ভোমরা বন্দর ব্যবহার হলে ব্যবসায়ীদের মালামাল পরিবহনে আর্থিক সাশ্রয় হয়। তবে বেনাপোলের কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভোমরা বন্দর ব্যবহারকারীরা বন্দরটির মারাত্মক ক্ষতি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন্দরে কর্মরত ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক আবদুল গফুর বলেন, ভারতের ঘোজাডাঙ্গা ও বাংলাদেশের স্থলবন্দর সীমান্ত জিরো পয়েন্ট থেকে সাতক্ষীরা মহাসড়কের ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা। বর্ষা মৌসুমে যেমন পানি জমে থাকে, তেমনি খরা মৌসুমে ধুলাবালিতে বন্দর এলাকা আচ্ছন্ন থাকে। ওয়ারহাউজের ১৭ একর জায়গা অত্যন্ত নিচু। বর্ষার সময় পানি কাদায় ভরে যায়। সেখানে মালামাল খালাস শ্রমিকসহ ভারত-বাংলাদেশের ট্রাক ড্রাইভারদের জন্য প্রয়োজনীয় শৌচাগার নেই। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। সরকারি ওয়ারহাউজের আয়তন মাত্র ১৭ একর জায়গা। সেখানে ভারতীয় ২৫০টি ট্রাক ও বাংলাদেশের ২৫০টি ট্রাক পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে শুধু পার্কিংয়ের অভাবে আমদানি মালবোঝাই ভারতীয় ট্রাকগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপ্রশস্ত জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকায় সব সময় যানজট লেগে থাকে। এর ফলে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো যথাসময়ে পার্কিংয়ে প্রবেশ করতে পারে না।

বন্দরে কর্মরত ভোমরা স্থলবন্দর গোডাউন হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি মোহাম্মদ এরশাদ আলী বলেন, এ বন্দরে ১২৫৩ জন শ্রমিক দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছে। শ্রমিকদের অন্য একটি সংগঠনের শ্রমিক সংখ্যা ১১৯৭ জন। তাছাড়া অনিয়মিত শ্রমিক রয়েছে আরও এক হাজার। যাদের রুটি-রুজির একমাত্র উপায় ভোমরা স্থলবন্দর। তাদের অভিযোগ ওয়ারহাউজ সরকারি হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করেন টেন্ডার কোম্পানি লিমিটেড। তাই শ্রমিকদের কষ্টে উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ তাদের পকেটে চলে যায়।

আরও পড়ুনঃ  কৃষিতে বড় ক্ষত

বন্দর ব্যবহারকারীদের সংগঠন ভোমরা কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি এজাজ আহমেদ স্বপন বলেন, ভোমরার বিপরীতে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট থেকে মাল বোঝাই ট্রাক প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হতো। এতে অনেক আমদানিকারককে ভোগান্তির কবলে পড়তে হয়। ভোমরার স্থানীয় কতিপয় ব্যবসায়ী ভারতীয়দের সিন্ডিকেট করে অবৈধ উপায়ে আদায়কৃত অর্থের ভাগ নিয়ে আসছিলো দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের অ্যাসোসিয়েশন আন্দোলন-সংগ্রাম করে অবৈধভাবে এ অর্থ আদায় বন্ধ করায় কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী আমার দিকে আঙুল তুলছেন। তবে অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকলেও এতে রাজস্ব আদায়ে কোনো প্রভাব পড়েনি।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন