শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ধাক্কা

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ধাক্কা

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট

  • রেকর্ড উচ্চতায় উঠবে জ্বালানির বাজার
  • রিজার্ভ বাড়িয়ে ধাক্কা সামলাবে রাশিয়া

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো বলেছে, ইতোমধ্যে ঘরছাড়া লক্ষাধিক মানুষ। ইউক্রেনের ৫০ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারে আশপাশের দেশে। করোনার কঠিন সময়ে ইউরোপে ফের শরণার্থীদের ঢল সামলাতে হিমশিম খেতে হতে পারে। সিরিয়া-ইয়েমেনের মতো মানবিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া মরিয়াভাবে যুদ্ধের মনোভাবের সামনে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আর প্রতিরক্ষা কৌশল-অস্ত্র সরবরাহে সীমাবদ্ধ থাকছে ন্যাটো জোট। তবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বসে থাকা রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বশে আনাটা কতটা বাস্তাবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা ও জাপান বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আসছে বলেও হুঁশিয়ারি দিচ্ছে দেশগুলো। এর মধ্যে রাশিয়ার সুইফট সেবা বন্ধ রাখা, ডলারের লেনদেনের বাইরে ঠেলে দেয়া, দেশটির ব্যাংকগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করা, জ্বালানি আমদানি বন্ধ করা এবং দেশটিতে প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানি বন্ধ করার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া অনেক আগে থেকেই এ পরিস্থিতির প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এর আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখলের পর রাশিয়ার ওপর বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এরপর থেকেই দেশটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি ডলারের নির্ভরতাও কমিয়ে এনেছে দেশটি।

স্বয়ংসম্পূর্ণতা বহুমুখীকরণের প্রচেষ্টায় চীনের সঙ্গে একটি নীতির সূচনা করেছে দেশটি। বেইজিংয়ের সঙ্গে এ চুক্তি গ্যাস পাইপলাইন পাওয়ার অব সাইবেরিয়া তৈরির পথ প্রশস্ত করেছিল। ২০১৯ সালে দুই দেশকে সংযুক্তকারী এ গ্যাস পাইপলাইন চালু করা হয়।

আরও পড়ুনঃ  ঢাকায় একই পরিবারের ৬ জন করোনা আক্রান্ত

রাশিয়া জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ যথেষ্ট আর্থিক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে ব্যবহার করেছে। মস্কো প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বসে আছে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে, দেশটির জাতীয় ঋণের পরিমাণও অনেক কম।

জার্মান থিংক ট্যাংক কিয়েল ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করলে রাশিয়ার জিডিপি ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। এছাড়া জ্বালানি তেল রপ্তানি বন্ধ হলে ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এ পরিস্থিতি টালমাটাল জ্বালানি বাজারকে রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কতটুকু পড়বে কিংবা এ উদ্যোগের ফলে রাশিয়া কতটুকু দুর্বল হবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা করছেন সেই হিসাব। এর মধ্যেই ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, এমনকি কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকা ক্রিপ্টোকারেন্সি এসেছে আলোচনায়। কোনো উপায়ে এর ব্যবহার থেকে কেউই কাউকে ঠেকাতে পারবে না। তাই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সফল হওয়া নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। আর ইউরোপ তার গ্যাস নির্ভরতার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে চাচ্ছে না।

বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রভাব

বিভিন্ন দেশে কয়েক দশকের রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে মূল্যস্ফীতি। এ অবস্থায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছে রাশিয়া। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকটগুলো আরো ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে নানা অনিশ্চয়তার শঙ্কায় জ্বালানির দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এরই মধ্যে কিছু দেশ ও শিল্পের ওপর মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আর এটি লাখ লাখ মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে। যেখানে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের মূল্য ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।

আরও পড়ুনঃ  বুধবার সকাল-সন্ধ্যা দেশব্যাপী ‘বাংলা ব্লকেড’

রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি প্রধান রপ্তানিকারক। আবার ইউক্রেনের খামারগুলো বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের খাদ্যের জোগান দেয়। এছাড়া একটি অনিশ্চিত অবস্থানে রয়েছে আর্থিক বাজারগুলোও। মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কয়েক বছরের রেকর্ড নিম্নপর্যায় থেকে সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছে। এ পদক্ষেপ সম্ভবত ভোক্তা ব্যয়কে ধীর করবে এবং আরেকটি মন্দার ঝুঁকি বাড়াবে।

এ অবস্থা ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকেও ধীর করে দিতে পারে। রাশিয়া থেকে অঞ্চলটি প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৪০ শতাংশ আমদানি করে। ব্যয়বহুল গ্যাস সার উৎপাদনকারী ও অন্যান্য ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন কমাতে বাধ্য করেছে। গত জানুয়ারিতে ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করা ১৯টি দেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে। এ মূল্যস্ফীতির হার ১৯৯৭ সালে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর সর্বোচ্চ।

বিশ্লেষকদের অনুমান, এ ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং জ্বালানি রপ্তানি থেকে মুনাফা স্থানান্তরে বাধা দেবে। যদিও কয়েক বছর ধরে রাশিয়া এ পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এজন্য রাশিয়ার চেয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি কিছুটা হলেও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

আসন্ন বিপর্যয়

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো বলেছে, ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরু হওয়ার পর ইতোমধ্যে অন্তত ১ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। চলমান পরিস্থিতির কারণে ইউক্রেনের ৫০ লাখ মানুষ আশপাশের দেশগুলোয় পালিয়ে যেতে পারে বলেও আভাস দিয়েছে সংস্থাগুলো। ফলে করোনার এ কঠিন সময়ে ইউরোপে আবারো শরণার্থীদের ঢল সামলাতে হিমশিম খেতে হতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ এলাকায় সিরিয়া-ইয়েমেনের মতো মানবিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  বাজারে চাল-ডাল, তেলের দাম বাড়তি

এই হামলা ও রক্তপাতের পর ইউক্রেনের ভেতর রুশবিরোধী মনোভাব এখন তীব্র ঘৃণার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। রুশদের ঠেকাতে ইউক্রেন সরকার দেশের সব সবল দেহী মানুষের মধ্যে অস্ত্র বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে শুরু হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধ। সম্ভবত আরেক আফগানিস্তানের পাকে পড়তে যাচ্ছে রাশিয়া।

দীর্ঘ যুদ্ধের শুরু

অনেকেই বলছেন, এই যুদ্ধে মস্কোর বিজয় অর্জিত হলে পুতিন তার সোভিয়েত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পাবেন। বেলারুশ ইতিমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক আঁতাতে যুক্ত হয়েছে। ইউক্রেন এবং মলদোভাও এই আঁতাতের সদস্যভুক্ত হবে। ফলে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি পোল্যান্ড থেকে তিন বাল্টিক রাষ্ট্রের সীমানা বরাবর প্রসারিত হবে। এটাই হবে ইউরোপের দুই অংশের মধ্যে নতুন সীমানা-চিহ্ন। শুরু হবে দ্বিতীয় ‘শীতল যুদ্ধ’।

ধরণা করা হচ্ছে ন্যাটো এ মুহূর্তে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য ন্যাটো প্রস্তুত ছিল বলে মনে হয় না। পুতিন সেই পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। ফলে তার অভিযান ইউক্রেনেই শেষ হবে, নাকি অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তা সহ্য করা রাশিয়ার জন্য কঠিন হবে। ইতিমধ্যে রুবলের মূল্য তলানিতে ঠেকেছে, শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। ফলে ঘরে-বাইরের চাপ হয়তো পুতিনতে থামাবে। নয়তো সীমাহীন এক যুদ্ধে জড়াতে পাশে পরাশক্তিগুলো। যেখান থেকে চাইলেও সহজে আর ফিরে আসাতে পারবে না কোনো পক্ষ।

সংবাদটি শেয়ার করুন