রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হিমাগারের ফাঁদে ফের আলুচাষি

হিমাগারের ফাঁদে ফের আলুচাষি

প্রায় প্রতিবছরই হয় হিমাগারে আলু মজুত রেখে অথবা মজুতের আগেই কৃষকদের ফাঁদে ফেলতে চায় হিমাগার মালিকপক্ষ। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মালিকপক্ষ জানান দিয়েছে এবারে বস্তায় ৫০ কেজির বেশি আলু হিমাগারে রাখা যাবে না। অথচ গতবারের ন্যায় কৃষক, ব্যবসায়ী ও আলু সংশ্লিষ্টরা বস্তা, পরিবহন ও শ্রমিকের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এ অবস্থায় মানববন্ধন ও কৃষক সমাবেশে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আলুচাষি ও ব্যবসায়ী এবং হিমাগার কর্তৃপক্ষের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান কামনা করেছেন।    

এ নিয়ে গত রবিবার রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি এলাকায় কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশে কোনো ফসলের ফলন বেশি হলে চাষিদের মুখে হাসি ফোটার বদলে নেমে আসে দুশ্চিন্তার ছায়া। ফসল সংরক্ষণের যে ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেটিকে কোনোভাবেই পরিপূর্ণ, আধুনিক ও টেকসই বলা যায় না। উল্টো হিমাগারমালিকদের কাছে জিম্মি হতে হয় কৃষকদের। আলু চাষের জন্য বিখ্যাত রাজশাহীর চাষিরা তেমনই বিপাকে পড়েছেন। বছরের পর বছর লোকসান দিয়েও আলু চাষ করে যাচ্ছেন তারা। হিসাব মতে গত ১০ বছরে ছয় বছরই আলুতে চাষি ও ব্যবসায়ীদের লোকসান গুণতে হয়েছে। এতে হিমাগার কর্তৃপক্ষের কিছু যায় আসে না। 

তারা বলেন, আলু রোপনের শুরুতেই প্রতিবস্তার আলুর ওজন ও নির্ধারিত ভাড়া চুক্তি করেই কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আলুচাষ করে থাকেন। কিন্তু প্রায় প্রতিবছরই হিমাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো না কোনো কারণে বিপত্তি বাধে। হিমাগারের মালিক পক্ষ নানান অযুহাত দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও আদায়ের চেষ্টা করে থাকেন।

এবারও রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় হিমাগারগুলোর মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। তারা আদালতের অজুহাত দেখিয়ে প্রতি বস্তায় ৫০ কেজির বেশী নিবেন না বলে জানান। এতে চাষি, ব্যবসায়ী ও আলু সংশ্লিষ্টরা বিপাকে পড়েছেন। বেশীরভাগ চাষি ও ব্যবসায়ী ও আলু সংশ্লিষ্টরা ৬০-৭০ কেজি আলু রাখার বস্তা কিনে ফেলেছেন। কারণ গত মৌসুমেও হিমাগারগুলোতে এমন ওজনের বস্তা রাখা হয়েছিল। 

আরও পড়ুনঃ  আমদানিতে বাধা নেই, রফতানিতে ভারতের যত আপত্তি

রাজশাহীতে আলু রাখা কোল্ডস্টোরেজ আছে ৩২টি। এসব কোল্ড স্টোরেজের ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ বস্তা। আলু রোপনের আগেই চাষি ও ব্যবসায়ীরা প্রায় প্রতিটি স্টোরেই অগ্রিম বুকিং করেছেন। সেই অনুপাতে বস্তাও (৬০-৭০ কেজি ধারণ ক্ষমতার) কিনে ফেলেছেন। হঠাৎ করে হিমাগার কর্তৃপক্ষ আলুচাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে বস্তায় ৫০ কেজি ওজনের বেশী আলু না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে একদিকে আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকার গুণবেন এবং অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে অতিরিক্ত দাম দিয়ে আলু কিনতে হবে।  

ভুক্তভোগি আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, আলুচাষি ও ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে নতুন মুনাফায় মেতেছে রাজশাহীর কোল্ডস্টোরেজ মালিকপক্ষ। মালিক পক্ষের সাজানো খেলায় আলুর নির্ধারিত মূল্যের বেশী টাকা গুণতে হবে চাষিদের। যার রেস ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাবে। ফলে বাজারে বেশী দামে আলু কিনতে হবে ক্রেতাদের।

তারা আরো বলেন, রাজশাহীর কোল্ড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে চাষি ও আলু ব্যবসায়ীরা বরাবরেই জিম্মি থাকে। কৃষকের কষ্টার্জিত উৎপাদিত আলুতেই শিল্পপতি হয়ে যাচ্ছেন কোল্ডস্টোরেজের মালিকরা। এরপরেও কৃষকের ওপর একটার পর একটা খড়গ চাপাচ্ছেন তারা। মালিকপক্ষ কৃষককে জিম্মি করে এবং সরলতার সুযোগে নিজেদের আখের গুছিয়ে যাচ্ছে।

চাষিরা বলেন, আলুচাষ ও উৎপাদনের সময় থেকে কোল্ডস্টোরেজের কর্মকর্তারা কৃষকের কাছে গিয়ে অনেক অফারের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেশীরভাগ চাষি ও ব্যবসায়রা আলুচাষ করে থাকেন। কিন্তু কোল্ডস্টোরেজে আলু রাখার সময় হতে তাদের চেহারা পাল্টে যায়। এবারে কৃষক ও চাষিদের ওয়াদা দিয়েছিল বস্তার আলু বেশী হলেও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হবে না। কিন্তু তারা সে ওয়াদা ভঙ্গ করতে চলেছে। 

আরও পড়ুনঃ  পর্যটনে নতুনদিগন্ত ডোমখালী সৈকত

পবার মদনহাটি গ্রামের আলুচাষি আব্দুল খালেক বলেন, প্রতিবছরই কোনো না কোনো কারণে চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা লেগে থাকে। চাষিদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় হিমাগার মালিকরা। তিনি বলেন, কোল্ডস্টোরেজ কর্তৃপক্ষ আলুচাষে ও রাখার জন্য সুদমুক্ত ঋণ দিলেও বিক্রির সময়ে ১৬ শতাংশ সুদ কেটে নেয়া হয়। চাষি ও ব্যবসায়ীর কাছে তাদের টাকা ছয়মাস থাকলেও পুরো বছরের সুদ নেয়া হয়। বছরের পর বছর চলছে তাদের এ কর্ম। কোল্ডস্টোরেজ করে তারা লোকসানের কথা বলেন। যদি কোল্ডস্টোরেজে লোকসান হয় তবে একই মালিকের প্রতিবছরই কোল্ডস্টোরেজ বাড়ে কেন? লোভ দেখিয়ে কোল্ডস্টোরেজ কর্তৃপক্ষ চাষিদের শুভংকরের ফাঁকিতে ফেলে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

তিনি আরো বলেন, কৃষকের সমিতি নাই। তাই তারা যেভাবে পারে কৃষকের কাছে থেকে মুনাফা আদায় করে। তবে তাদের কিছু নির্ধারিত দালাল চাষি ও ব্যবসায়ী আছে। এরাও কৌশলে চাষিদের কথা বলে নিজেদের আখের গোছানোই ব্যস্ত থাকে। চাষিরা বলেন, গত বছরে প্রতিটি হিমাগার আলু সংরক্ষনের জন্য প্রতিবস্তার নির্ধারিত মূল্য ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সেই আলোকেই চাষিরা তানোরের এ এম কোল্ডষ্টোরে হিমাগারে আলু সংরক্ষন করে। আলু সংরক্ষরে পর সেই আলু বিক্রয় করতে গেলে এ এম কোল্ডষ্টোরে ব্যবস্থাপক (প্রতিবস্তা ৫৫ কেজি) উপরে আলু রাখলে প্রতিকেজি ২ টাকা করে অতিরিক্ত বেশী ভাড়া দিতে হবে বলে জানান। এছাড়া তিনি নিজে কোনো আলুর ডিও করে বের করতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এটা হিমাগার কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বলে চাষিদের জানান।

আরও পড়ুনঃ  'উইনিং ফর্মুলা' মিলেছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার

এ বিষয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ব্যবস্থাপককে অবরুদ্ধ করে চাষিরা। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে ম্যানেজারকে উদ্ধার করে। এ নিয়ে আবু বাক্কার ও আতাউর রহমান, আরব আলী, আব্দুল মতিন মাসুদ আলীসহ উপস্থিত কয়েকশত আলু চাষিরা জানান, আলু হিমাগারে সংরক্ষণের সময় আমাদের ২৫০ টাকা ভাড়া বাবদ ও ১০ টাকা শ্রমিক খরচ বাবদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু সেই নির্ধারণের মূল্য চেয়ে (প্রতিবস্তা ৫৫কেজি) উপরে যাদের বস্তাতে আলু আছে। প্রতিকেজি ২ টাকা করে বেশী কর্তন করা হয়। যা এক রকম চাঁদাবাজি। এছাড়াও তারা আরো জানান, আলুর দাম না থাকার এবারো তাদেরকে  লোকশান গুনতে হবে।

রাজশাহী জেলা হিমাগার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বলেন, চাষি বাঁচলে আমরা বাঁচবো। চাষিদের নিয়েই আমাদের অবস্থান। হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে বস্তায় ৫০ কেজি। সেখানে কাঁচামাল শুকিয়ে যেতে পারে বলে ৫৫-৬০ কেজি বলা হয়। কিন্তু চাষি ও ব্যবসায়ীরা অনেকে এর চেয়ে বস্তায় বেশী আলু রাখেন। তবে লোকসানের কথা ভেবেই কয়েকদিনের মধ্যে কমিটিতে আলোচনা করা হবে। আশা রাখি বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন