শীতের সকাল। কুয়াশায় ভেজা, কম্বল মোড়ানো। খানিকটা অলসতা। বাহারী মৌসুমি খাবার। গ্রামীণ জনপদের এসব সংস্কৃতি চোখে পড়ে প্রতি শীতেই। শীত মৌসুমে একটি অনন্য আকর্ষণ খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা রস। গ্রামাঞ্চলে খেজুরের রস নামে পরিচিত। বলা যায় গ্রামগঞ্জে শীতের আগমণ ঘটে খেজুরের রসের মাধ্যমেই। চলে পুরো শীত মৌসুমজুড়ে।
প্রতি বাংলা সনের মাঘ মাস তথা ইংরেজি জানুয়ারী মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। গাছিরা রস সংগ্রহের প্রস্তুতি শুরু করে সেপ্টেম্বর মাস থেকেই। সাধারণত ৫ থেকে ৬ বছর বয়সী খেজুর গাছের রস আহরণ শুরু করা যায়। তুলনামূলক স্ত্রী গাছের চেয়ে পুরুষ গাছ থেকে সংগ্রহ করা যায় বেশি রস। এর পরিমাণ নির্ভর করে শীতের মাত্রার উপর। শীত যত বাড়ে রস তত বেশি সংগ্রহ করা যায়। ঠান্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল রস সংগ্রহের উপযোগী সময়।
নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ায় খেজুরের সংগ্রহ করেন গাছিরা। প্রয়োজন হয় স্বল্প মূল্যের কিছু উপকরণ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাছাইকৃত খেজুর গাছে উপরের দিকে স্থান নির্ধারণ করে নিতে হয়
এরপর সেখানে গাছের ছাল তুলে ফেলে সাদা অংশ বের পরিষ্কার করে গাছে মাটিরপাত্র বেঁধে দেওয়া হয়। প্রতিদিন ঠিলায় রস নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ওই স্থান পরিষ্কার করা হয় ধারালো চাকু বা কাঁচি দিয়ে। এরপর বাঁশের একটি নল গাছা ঠুকিয়ে তার মুখ দেওয়া হয় ঠিলার মাঝে। প্রতি সকাল হলে সেই হাড়ি নামিয়ে আনা হয়। গাছ ও মৌসুমভেদে বিভিন্ন পরিমাণের সংগ্রহ করা হয় শীতের প্রতি ভোরে।
শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুলের সফির মিয়া জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি খেজুরের রস সংগ্রহ করেন। প্রতিবছর প্রায় ৩০টি গাছ থেকে সংগ্রহ করেন। একটি করে মাটিরপাত্র অথবা প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করেন। প্রতি ঠিলায় ৪ কেজি থেকে ১৫ কেজি রস সংগ্রহ করেন প্রতি ভোরে। খুঁচরায় প্রতি কেজি রস বিক্রি করেন ২০ থেকে ৩০ টাকা। সেই হিসেবে ১০কেজি রস বেচে পান ৩০০ টাকা। তবে মাঝরাতে অনেক সময় রস ভর্তি পাত্র হারিয়ে চুরি হওয়া কথাও জানান তিনি।
শীতকালীন সবচেয়ে আকর্ষণ হিসেবে দিনের শুরুতে খেজুরের রস খেয়ে থাকেন গ্রাম বাংলার মানুষ। অনেক সময় শহরেও পাওয়ায় যায় সৌখিন এ রস। জনপ্রিয় বাজারগুলোতে ধুম করে বিক্রি হয় বড় ঠিলা ভর্তি রস। এছাড়া ভ্যান ও গ্রামীণ ঐতিহ্য কাধে ভার করেও ঠিলা নিয়ে বিক্রি করে দেখা যায়। স্থান ভেদে প্রতি গ্লাস রস বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৫ টাকায়। এছাড়া রস দিয়ে গুড়-পাটালি, লালি গুড় তৈরি করা করা হয়। এ গুড় ব্যবহার করে তৈরী করা হয় শীতকালীন পিঠাপুলি, খির, পায়েস, ভাপাপিঠাসহ হরেক রকমের মুখরোচক খাবার।
তবে খেজুরের রসের আগ্রহ অনেকের মাঝেই এখন কম দেখা যায়। বিশেষ করে খাঁটি রস পাওয়ায় পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ অনেকেরই। খাঁটি রসে পানি মিশিয়ে বিক্রি করা হয় বলে মনে করেন অনেকেই। এছাড়া গাছে ঝুলিয়ে রাখা মাটির ঠিলায় কীটপতঙ্গ প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর রসে পরিণত করার শঙ্কার কারণেও অনেকে খেজুরের রস পান করেন না।
খেজুর গাছ আগের তুলনায় বেশ কমতে শুরু করেছে। জ্বালানি হিসেবে দেশের প্রায় ইট ভাটাগুলোতে প্রতিনিয়ত খেজুর গাছ পোড়ানো হচ্ছে। গ্রাম বাংলার প্রচীন এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রয়োজন খেজুর গাছ লাগানো। পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ।