শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রুপালী পর্দা এখন স্মৃতি

রুপালী পর্দা এখন স্মৃতি

এক সময় টাঙ্গাইলে সিনেমা হল ছিল ৫১টি। বর্তমানে টিকে আছে মাত্র ৫টি। ওই সময়ে জেলা শহরেই ৫টি সিনেমা হল ছিল। প্রতিটি হলেই ছিল দর্শক সমাগম। হলে টিকিট কিনতে কিংবা প্রবেশ প্রথে দর্শকদের ছিল লম্বা লাইন। অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘ সময়। হলের ভেতরে ঘাম ঝরলেও দর্শকের চোখ আটকে থাকতো বড় পর্দায়। ঈদ বা পূজোতে সিনেমা দেখতে ঢল নামতো সিনেমা হলে। টাঙ্গাইল জেলা শহরের সবকটি হল বন্ধ হলেও খুঁড়িয়ে চলছে মালঞ্চ সিনেমা হলটি। এটি বন্ধ হলে টাঙ্গাইল শহরে বিনোদনের জন্য কোনো সিনেমা হল থাকবে না। পরবর্তীতে ভালো সিনেমা তৈরি হলেও টাঙ্গাইলের দর্শকদের দেখার কোন সুযোগ থাকবে না।

নব্বই দশকে জেলার অর্থনীতিতে সিনেমা হলের প্রভাব ছিল। সিনেমা হল চালানো, ব্যবস্থাপনা, গেটকিপার, পরিদর্শক, মাইকম্যান, রিকশাচালক, ঝাড়ুদারসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান ছিল। সিনেমা হল বন্ধ হওয়ায় এসব মানুষ এখন বেকার হয়ে পড়েছে। শহরে প্রথম সিনেমার ব্যবসার শুরু করেন ময়মনসিংহ ছায়াবানী সিনেমা হলের মালিক নটুকর।

১৯৬০ সালে শহরের পার্ক বাজারের পাশে আরফান খানের গুদাম ঘর ভাড়া নিয়ে কালী সিনেমা চালু করেন। যদিও আজাহার উদ্দিন চৌধুরী তাদের অংশীদারিত্ব কিনে নতুন করে লাইসেন্স করেন। এসডিও বরাবর প্রিটিশন করেন এবং সেই এসডিও আজাহার উদ্দিন রওশন টকিজ নাম দিয়ে শহরের নিরালা মোড়ে করোনেশন ড্রামাট্রিক ক্লাব (সিডিসি) হল রুম ভাড়া নিয়ে সিনেমা চালাতে থাকেন। পরবর্তীতে আজাহার উদ্দিনে ৩ ছেলে আজিজুর রহমান চৌধুরী খোকা, মোজাহারুল ইসলাম লেবু ও আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী আবু দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে মেজ ছেলে মোজাহারুল ইসলাম লেবু ধনবাড়ী উপজেলায় মধুসন্ধ্যা সিনেমা হল, মির্জাপুরে অনামিকা সিনেমা হল ও নাগরপুরে আরো একটি সিনেমা হল নির্মাণ করেন।

আরও পড়ুনঃ  শীতজনিত রোগে সিরাজগঞ্জে ৪৮৪ জন হাসপাতালে‌!

১৯৭৬ সালে রওশন টকিজের অংশীদারগণ শহরে ‘রুপসী সিনেমা’ নামে আরেকটি সিনেমা হল নির্মাণ করেন। মোজাহারুল ইসলাম লেবু ১৯৮৭ এবং ১৯৮৯ সালে এককভাবে এলাসিনে আশা সিনেমা এবং পাথরাইলে চৌধুরী টকিজ নামে দুটি সিনেমা হল তৈরি করেন। ২০০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় রওশন টকিজটিও। ২০০৮ সালে রুপসী সিনেমা হলটিও বন্ধ হয়। ১৯৭৪ সালে আফজাল চৌধুরী তৈরী করেন কেয়া সিনেমা হল।

২০১০ সালের পর থেকে সিনেমায় লোকসান হতে থাকে। ২০১৯ সালে কেয়া হলটিও বন্ধ হয়। ১৯৬৪ সালে মন্টু চৌধুরী নির্মাণ করেন নীলাগ সিনেমা হল। নীলাগ পরিবর্তন হয়ে রুপবাণী নাম হয়। যা এখন বন্ধ। টাঙ্গাইলের করটিয়াতে ফরিয়া ও নন্দিনী হল দুটিও বন্ধ হয়। ১৯৭৫ সালে আতাউর রহমান মানিক, বজলুর রহমান হীরা, ফয়জুর রহমান মাখন ও লুৎফর রহমান সানা শহরে মালঞ্চ সিনেমা হল নির্মাণ করেন। ২০০৭ সালে আমেরিকা প্রবাসী জুয়েলের নিকট মালঞ্চ হলটি মালিকানা বিক্রি করেন।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মালঞ্চে চলছে আলোচিত হাওয়া সিনেমা। হাওয়াও হলের হাওয়া বদলাতে পারেনি। হাতে গোনা কিছু দর্শক। টিকিট কাউন্টারে নেই ভিড়। প্রথমে রওশন টকিজ, তারপর রুপসী, রুপবাণী,সবশেষে কেয়া সিনেমা হল বন্ধ হয়। দর্শকের অভাবে সর্বশেষ টিকে থাকা মালঞ্চ সিনেমা হলও বন্ধের উপক্রম। সে রকমই আভাস দিলেন ব্যবস্থাপক শামছু। হাওয়া সিনেমার দর্শকরা জানান, ইউটিউবে সব পাওয়া যায়। এতে ফ্রি সময়ে বাড়িতে বসেই বিনোদন উপভোগ করা যায়। এজন্য দর্শনার্থীরা সিনেমা হল বিমুখ হয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে, ভালো গল্প আর সিনেমা হলের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব । হাওয়া সামাজিক গল্প হওয়ায় তারা হলে এসেছেন বলেও জানান ।

আরও পড়ুনঃ  মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে মারধর : গৃহীত পদক্ষেপ জানতে চায় হাইকোর্ট

এদিকে ৩০টাকার বক্সের টিকিট মুল্য হয়েছে ১০০ টাকা। দ্বিতীয় তলার ডিসির ২০টাকার টিকিট হয়েছে ৮০ টাকা। আরস্টল ,স্টল, ফ্রন্টস্টল এক করে নিচতলার ১০ টাকার টিকিট ৬০টাকা। ৫/৬ গুন টিকিট মুল্য বৃদ্ধি পাওয়ার পরও দর্শক কমে যাওয়ায় হলগুলো লেকসানের মুখে। ভালো প্রজেক্টরের অভাবে অস্পষ্ট ছবি প্রদর্শন হচ্ছে। একটি ভালো মানের প্রজেক্টরের দাম ৩০ লক্ষ টাকা। অথচ সিনেমা চালানো হচ্ছে ৫০ হাজার টাকার প্রজেক্টর দিয়ে। যার কারণে রুপালী পর্দা অস্পস্ট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি ভালো গল্পের অভাব, মানসম্মত সিনেমা নির্মান ও নোংরা পরিবেশের কারণে সিনেমা হল হারাচ্ছে দর্শক। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের গল্প ও নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি প্রদর্শন ব্যবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। একটা সুন্দর চলচ্চিত্র নির্মাণের পর তা পেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের মাধ্যমেই তার সফলতা আসে। প্রেক্ষাগৃহে সুন্দর পরিবেশে দর্শকসমাগম  হয়।

টাঙ্গাইল জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল কর্মকর্তা এরশাদ হাসান বলেন, সাংস্কৃতি হচ্ছে মনের খোরাক। প্রযুক্তির উন্নয়নে সাংস্কৃতির বড় মাধ্যম রুপালী পর্দা বিলুপ্তির পথে। ফেসবুক, ইউটিউব বা অনলাইনের মাধ্যমে সহজেই সিনেমা দেখা যায়। ফলে হল দর্শক হারাচ্ছে। দর্শক শূন্যতায় অধিকাংশ হল বন্ধ হচ্ছে। তবে সারাদেশে সরকারিভাবে একটি করে সিনেমা হল নির্মানের পরিকল্পনা করছে সরকার।

টাঙ্গাইল জেলা তথ্য অফিসের সহকারী পরিচালক তাহলিমা জান্নাত বলেন, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে সিনেমা হলের সংখ্যা কমছে। জেলায় ৫১টি সিনেমা হল ছিল। এখন শহরে একটি সিনেমা হল চালু আছে। অনলাইন, ইউটিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে সহজেই ছবির অংশ বিশেষ দেখা যায়। ফলে দর্শক হলের প্রতি অনাগ্রহ। এছাড়া সিনেমা মুক্তির আগেই নানাভাবে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। এতেও সিনেমা হল দর্শক হারাচ্ছে। সিনেমাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমত প্রত্যেক জেলায় একটি করে তথ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন