দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করছে। এ হার ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন। পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, পরিবারের সাথে অভিমান, প্রেমঘটিত সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যা বাড়ছে বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় জানানো হয়।
গতকাল শনিবার ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েছে আত্মহত্যা: ‘হতাশায় নিমজ্জিত শিক্ষার্থীরা’ শীর্ষক অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ ও জেনারেল সেক্রেটারি সামিরা আক্তার সিয়াম।
গবেষণায় জানানো হয়, ২০২১ সালে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর মাঝে ১০১টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যা ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২টি, যা মোট আত্মহত্যা ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন, যার হার ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ জন, হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আর সবচেয়ে কম আত্মহত্যা করেছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ জন। জগন্নাথে ৬ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ জন এবং রাজশাহীতে ৪ জন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে আত্মহত্যা করেছে। যাদের সংখ্যা ৩ জন।
আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২২-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। সমন্বয়কৃত তথ্যগুলোর মধ্যে ৬০টি আত্মহত্যার ঘটনা এই বয়সসীমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে। যা মোট ঘটনার ৫৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে ১৮-২১ বছর বয়সী তরুণদের আত্মহত্যার ঘটনা মোট সমন্বয়কৃত ঘটনার ২৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ বা ২৭ জন। এছাড়া ২৬-২৯ বছর এবং ২৯ বছরের উর্ধ্বে এই হার যথাক্রমে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ যা সংখ্যায় যথাক্রমে ১০টি ও ৪টি।
সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি থাকলেও এবার উল্টো। গতবছর আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশই ছিলো পুরুষ শিক্ষার্থী। সর্বমোট ৬৫ জন পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা, করে যা মোট শিক্ষার্থীর ৬৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ছিলো ৩৬ জন বা ৩৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পুরুষ আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা নারীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। করোনার মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়া পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
মাসভিত্তিক আত্মহত্যা প্রবণতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসে এই হার সবচেয়ে বেশি ছিলো যা সমন্বয়কৃত ঘটনার ১৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ বা ১৫ জন এবং সবচেয়ে কম ছিলো এপ্রিল মাসে যা ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ বা ২ জন। গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা যায়।
আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, অনার্স পড়ুয়া ৩য় এবং ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি যা ৩৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ধারণা করা যায়, এই শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মাঝে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। সম্পর্কগত কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে এ পথে ধাবিত হয়েছে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। দুঃখজনক হলেও সত্য, পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং আর্থিক সমস্যায় আত্মহত্যা করেছেন ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। মাদকাসক্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ও নানাবিধ কারণে ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
তানসেন রোজ বলেন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারাকে
আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান নিয়ামক। তিনি বলেন, পত্রিকা বিশ্লেষণ করে এটা স্পষ্ট যে, আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তার চেয়েও গভীর। নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত বিধায়, তাদের জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তারা সেটা সামলাতে পারে না। এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরবর্তীতে অনুশোচনা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় দায়িত্বশীলদের অবদান রাখার সঠিক সময় এখনই।
অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশেষত কোভিড পরিস্থিতিতে এই বিষয়ের পরিসংখ্যান এবং তার ফলাফল যথেষ্ট ভীতিকর। কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে আমরা যতখানি আতঙ্কিত, আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করা অসংখ্য মানুষকে নিয়ে কিন্তু আমরা ততোটা চিন্তিত নই।
সামিরা আক্তার সিয়াম বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক সংস্থা, প্রফেশনাল এসোসিয়েশন, বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্তকরণ এসডিজি এবং লিগ্যাল ইন্সট্রুমেন্ট সম্পর্কিত কৌশল বিনির্মাণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে ১০ দফা প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ১. প্রতিটি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল নিয়োগ দেওয়া এবং ইয়্যুথ অর্গানাইজেশনকে যথাযথ ট্রেনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা। ২. পলিসি ডায়ালগে তরুণদের সম্পৃক্ত করা। ৩. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও সেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করা। ৪. মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ট্যাবু ও হীনমন্যতা দূরীকরণে প্রাথমিক স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা। ৫. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহে জরুরি ভিত্তিতে একটি জাতীয় হটলাইন সেবা চালু করা। ৬. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে বিশেষ অ্যাপস চালু করে মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা করা। ৭. প্রান্তিক পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তরুণদেরকে মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড ট্রেইনিং সরবরাহ করা। ৮. শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারি-বেসরকারী উদ্যোগে যুগপৎভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন আয়োজন করা। ৯. সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভূমিকা জোরদার করা। ১০. মানসিক চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ ফি ও ঔষধের দাম কমানো।
২০১৯ সালের ২৫শে এপ্রিল সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের পথ চলা শুরু। তরুণ প্রজন্ম দ্বারা পরিচালিত এই সংগঠন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করছে। আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনাই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য।
আনন্দবাজার/শহক