কোথাও দুই থেকে তিন জন, কোথাও আট থেকে দশ জন, আবার কোথাও কোথাও দেখা যায় পনেরো থেকে বিশ জনকে গোল হয়ে বসে থাকতে। সবাই ইফতার নিয়ে বসে আছে, কখন মাগরিবের আযান হবে; তাঁরা সারাদিনের ক্লান্তি ভেঙে মহান সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করবে। বলছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের ইফতার করার দৃশ্যের কথা। প্রতি বছর সিয়াম সাধনার মাসে এভাবেই গোল হয়ে বসে ইফতার করাটা ঢাবির সৌন্দর্যকে কে আরও বাড়িয়ে দেয়; তুলে ধরে অনন্য রুপে।
ঢাবিতে এখনও শুরু হয়নি রমযানের ছুটি। বিভিন্ন বিভাগে চলমান রয়েছে নিয়মিত ক্লাশ ও পরীক্ষা। যে কারণে সকল আবাসিক শিক্ষার্থী সহ অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাও অবস্থান করছেন ক্যাম্পাসে। তাই পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে ইফতার করার কষ্ট ভুলে গিয়ে দ্বিতীয় পরিবার খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু -বান্ধব, বড় ভাই-বোন , ছোট ভাই -বোনদের সাথে একসাথে ইফতার করার আনন্দে মেতে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন দল, উপদলে বিভক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, হাকিম চত্বর,লাইব্রেরি চত্বর, ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, সবুজ চত্বর, মল চত্বর এবং আবাসিক হলগুলোর মাঠসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় গোল হয়ে ইফতার করার দৃশ্য । যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে টিএসসির (শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্র) মাঠ। এখানে প্রতিদিন বিকেল হতে হতে জড়ো হতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। কেউবা জায়গা দখল করতে ব্যস্ত, কেউবা ইফতারের আইটেম ম্যানেজ করতে ব্যস্ত, আবার কেউবা সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে শরবত বানাতে ব্যস্ত। যা সংযম ও ত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঠিক একই চিত্র দেখা যায় আবাসিক হলগুলোতেও। বিকেল হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজেদের বন্ধু-বান্ধবসহ ইফতার তৈরিতে।
এবার ঢাবি ক্যাম্পাসে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় আলাদা রুপ ধারণ করেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল, পল্লীকবি জসীম উদ্দিন হল এবং সূর্যসেন হল নিয়ে হল পাড়া। জসীম উদ্দিন হলের মাঠের পাশে প্রতিদিন বিকেল হলে বসে ইফতারের বাজার। এখানে মুড়ি, ছোলা এবং হরেক রকমের চপ বাদেও পাওয়া যায় ফলমূল। তাই বিকেল হওয়ার সাথে সাথে ইফতারের আগ পর্যন্ত দেখা মিলে একটি গ্রাম্য বাজার দৃশ্যের।
পরিবার ছেড়ে আসা প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তৈরি করা ইফতার দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন। এতে নেই কোনো বিবাদ, নেই কোনো উচুঁ-নিচুঁ ভেদাভেদ। সকলের সতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই প্রতিদিন বিভিন্ন হল, ডিপার্টমেন্ট, জেলা-উপজেলার শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় এই ইফতার কার্যক্রমে। যা এক অনন্য ভালোবাসার উদাহরণ।
কথা হয় টিএসসিতে ইফতার করতে আসা কয়েকদল শিক্ষার্থীদের সাথে। তারা সবাই জানান একসাথে ইফতার করার আনন্দ। হলের বন্ধুদের সাথে ইফতার করতে টিএসসিতে এসেছেন লোকপ্রশাসন বিভাগের রিফাত। তিনি জানান একসাথে ইফতার করার অনুভূতি।
রিফাত বলেন, পরীক্ষা চলার কারনে আগের দিনগুলোতে হলেই ইফাতারি করেছি। আজকে সবাই মিলে টিএসসিতে এসেছি। ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে বন্ধু – বান্ধব, সিনিয়র – জুনিয়রদের মাঝে খুবই ভালো লাগা কাজ করতেছে এবং গভীর সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সর্বোপরি পারিবারিক বন্ধনের ন্যায় ভালোবাসা পুনঃজাগরিত হচ্ছে।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান জানান, প্রতি বছর রমাযানের বেশ কয়েকটা দিন ক্যাম্পাসে কাটাতে হয়। যে কারণে হলের, ক্যাম্পােসের অথবা এলাকার সহপাঠী, বড় ভাই- ছোট ভাইদের সাথে ইফতার করতে হয়। এতে কিছুটা খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই; এটাই বাস্তবতা। তবে একসঙ্গে ইফতার করার মাধ্যমে আমাদের আন্তঃসম্পর্কগুলো আরও মজবুত হয়। যা এক অনন্য শিক্ষা।
ওই শিক্ষার্থী আরও জানায়, এ অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ। এ যেন আরেক পরিবার। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র জুনিয়র সবাই ছিলো আজকের ইফতার পার্টিতে। অনেক অনেক ভালো লেগেছে। রমযানের এ শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সকল ক্ষেত্রে।
আনন্দবাজার/শহক