সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি গণমাধ্যমে ভাষার বিকৃত উপস্থাপন খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাড়িঁয়েছে। ফেসবুকের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যায়, কেউ বিকৃত করে ভাষার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, কেউবা ভুলভাবে ভাষার উপস্থাপন করছেন। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, এফএম রেডিও, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও হচ্ছে। অধিকাংশই ব্যাকরণ বা অভিধানের ধার ধারেন না। ফলে এর মাশুল দিচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। আর যদি কর্মস্থল বা কাজের প্রয়োজনে বাংলা লিখতে হয়, তাহলে বিভিন্ন শব্দের বানানের সঠিক-ভুল নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকতে হচ্ছে তাদের। ফলে অনেকেই দৃষ্টিকটু ভুলও করছেন। এবার বাংলা বানানের ভুল শনাক্ত ও সংশোধন করে দিবে ‘সঠিক’ অ্যাপ।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা বানানের প্রচলিত অভিধান (ডিকশনারি) প্রতি সাধারণ ব্যবহারকারীদের অনীহা ছিলো। এতো বড় ডিকশনারি খুঁজে সঠিক বানান বরে করা একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপারও বটে। তাই অনেকে বিভিন্ন অ্যাপ বা অনলাইনের সহায়তার আশ্রয় নিতেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেসব মাধ্যমও পর্যাপ্ত ছিলো না। এবার সে জায়গাটি গোছাতে যাচ্ছে ‘সঠিক’ অ্যাপ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এবার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলা শব্দের বানানে ভুল শনাক্ত বা সংশোধনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর আওতায় ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে দেশের প্রথম স্পেল চেকার সফটওয়্যার ‘সঠিক’। এই সফটওয়্যার ব্যবহারে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান বিধি ও প্রমিত বানান অভিধানকে অনুসরণ করা হয়েছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সঠিক অ্যাপের পরীক্ষামূলক ভার্সন উন্মুক্ত করা হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এ বিষয়ে বলেন, সঠিক অ্যাপ তৈরি হয়েছে। আমরা এখন অ্যাপের পরীক্ষামূলক ভার্সন উন্মুক্ত করেছি। আমি নিজেও অ্যাপ ব্যবহার করে এর গুণগত মান যাচাই করতে চাচ্ছি। আশা করছি চলতি বছরেই ব্যবহারকারীদের মতামত নিয়ে অ্যাপটিকে আরও উন্নত ও নির্ভুল করে পূর্ণাঙ্গ ভার্সন প্রকাশ করা হবে।
‘সঠিক’ অ্যাপ সম্পর্কে তথ্য: ‘সঠিক’ বানান সংশোধক হলো বাংলা ভাষার শব্দ, বাক্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সম্পাদনা করার সফটওয়্যার। এই সফটওয়্যার কেবল ভুল বানান শনাক্ত করবে তা নয়, বরং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধনের পরামর্শ দেবে। সফটওয়্যারটি বিভিন্ন ধরনের এরর যেমন নন-ওয়ার্ড এরর, রিয়েল ওয়ার্ড এরর শনাক্ত করতে পারে। এ ছাড়া প্রায়ই যেসব বানান ভুল হয়, সেসব বানানসহ অসতর্কতাবশত লেখা ‘টাইপো’ দ্রুত শনাক্ত করতে পারে। তবে একটি শব্দের বানান শুদ্ধ হলেও ওই পরিস্থিতিতে শব্দটি ভুল হলে অ্যাপ্লিকেশন একে ভুল হিসেবে শনাক্ত করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি হওয়ায় এর রয়েছে কনটেক্সচুয়াল এরর চেকিংসহ বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় ফিচার, যা একাডেমি প্রকাশনা, মুদ্রণ জগৎসহ অনলাইনে শুদ্ধ বানানে লেখার অভিজ্ঞতা বদলে দেবে।
এছাড়াও এ সফটওয়্যারটি লেখালেখির সঙ্গে সম্পর্কিত কম্পিউটার জগতের গুরুত্বপূর্ণ সব মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে। এ জন্য সফটওয়্যারটির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ডিস্ট্রিবিউশন। যেমন এর মাধ্যমে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে সাধারণ কম্পোজের সময় বানান পরীক্ষা ও সংশোধন করা যাবে একটি ‘অ্যাড-ইন’-এর মাধ্যমে। এ জন্য অন্য কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে না। বহুল ব্যবহূত ক্রোম, ফায়ারফক্স, সাফারি ও এইজ ব্রাউজারের জন্য রয়েছে এক্সটেনশন। এর মাধ্যমে ফেসবুক, জিমেইল, গুগল ট্রান্সলেশনে বাংলা বানানের শুদ্ধাশুদ্ধ যাচাই করা যাবে। এ ছাড়া রয়েছে মোবাইলে কিবোর্ড অ্যাপগুলোতে ব্যবহারের জন্য সার্ভিস অ্যাপ, যার মাধ্যমে প্রচলিত যে কোনো কিবোর্ডে বানান সংশোধন করা যাবে।
স্বতন্ত্র কিবোর্ড: সঠিক অ্যাপের সার্ভিস অ্যাপ ছাড়াও রয়েছে একটি স্বতন্ত্র কিবোর্ড, যার মাধ্যমে হোয়াটস অ্যাপ, মেসেজে শুদ্ধ বাংলা নিশ্চিত করা যাবে। ডিজাইন ও প্রিন্টিংয়ের কাজের জন্য এ অ্যাপের রয়েছে ইলাস্ট্রেটর অ্যাড-ইনস। সঠিক সফটওয়্যারটি অন্য ডেভেলপাররা যাতে ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য রয়েছে অ্যাপিআই। এ ছাড়া সব ফিচারসহ অ্যাপের একটি স্ট্যান্ড-অ্যালোন ভার্সন রয়েছে; যা একই সঙ্গে উইন্ডোজ, লিনাক্স, ম্যাক এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন হিসেবেও কাজ করবে। সঠিক সফটওয়্যারটিতে ইনলাইন এডিটিং ও সাইডবার এডিটিং দুই ধরনের ফিচারই রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অনুচ্ছেদ রিভিউ করার সময় সম্পাদনা করতে পারবে।
প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে, ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্পের আওতায় সঠিক অ্যাপ প্রণয়নের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। সফটওয়্যারটি তৈরি করছে রিভ সিস্টেম লিমিটেড। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
‘সঠিক’ দেশে বাংলা ভাষা বানান বিষয়ক প্রথম সফটওয়্যার উল্লেখ করে প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব করিম বলেন, অভ্র নামে একটি স্পেল চেকার আছে, সেটি সীমিত পরিসরে। এই সফটওয়্যারটি দিয়ে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের জন্য অনেক কিছু করা যাবে। প্রথম দিকে ব্যবহারের সময় কিছু কারিগরি সমস্যা হতে পারে, তবে ব্যবহারকারীদের মতামত নিয়ে পর্যায়ক্রমে তারও সমাধান করা হবে। আশা করছি, গণমাধ্যম, মুদ্রণশিল্পসহ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী সবাই এর সুফল পাবেন।
তথ্যপ্রযুক্তিতে অজ্ঞতার কারণে বাংলা ব্যবহারে আমরা পিছিয়ে রয়েছি উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. হাকিম আরিফ বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির উপকরণ (কম্পিউটার-মোবাইল) যারা তৈরি করেছেন, তাঁরা শুরুতেই ইংরেজি ভাষায় সেটি করেছেন। তাঁরা অন্য ভাষাকে প্রাধান্য দেননি। তবে দিন যতই যাচ্ছে, ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা আমাদের দেশে ব্যবহার হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন টুল তৈরি হচ্ছে। সরকারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সঠিক অ্যাপ যেটা তৈরি হয়েছে, আশা করছি এ অ্যাপ তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে উৎসাহ জোগাবে। এটি সার্বিকভাবে ব্যবহারিক দিক দিয়ে বাংলা ভাষাকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
আনন্দবাজার/কআ