শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চালে নয় ঘাটতি তথ্যে

চালে নয় ঘাটতি তথ্যে

ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরা বসুন্ধরার সেরা বাংলাদেশ। ধান-চালের দেশ বললেও বেশি ভুল হয় না। হাজার নদীর অববাহিকার উর্বর পলিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও রয়েছে বিশ্বের শীর্ষে। চীন-ভারতকে বাদ দিলে চাল উৎপাদনে আমরাই বিশ্বসেরা। স্বাধীনতার পর থেকে গেল ৫০ বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন এক টন থেকে বেড়ে এখন ৪ টন। প্রতিবছরই আগের রেকর্ড ভেঙে দেশে চাল উৎপাদন হচ্ছে। অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে খাদ্য উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। চাহিদার তুলনায় চালের উৎপাদনও বেড়েই চলেছে। তবে বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, উৎপাদনে যেমন বিশ্বে রেকর্ড ভেঙে চলেছি আমরা, একইভাবে আমদানিতেও রেকর্ড গড়ে চলেছি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ধরে দেশে বছরে চালের চাহিদা ২ কোটি ৮০ লাখ টনের বেশি। তবে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে হিসাবে ধরে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাব বলছে, দেশে চালের বর্তমান চাহিদা ৩ কোটি ৫৩ লাখ টনের মতো। এই চাহিদার বিপরীতে গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন চাল। হিসাব ঠিক থাকলে বছরে ৩৪ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে বছরে সর্বোচ্চ চাল আমদানির পরিমাণ ৩৯ লাখ টনের মতো। এ হিসাবও সঠিক থাকলে উদ্বৃত্ত আর আমদানি মিলে ৭৩ টন চাল মজুদ থাকার কথা।

গত বছরের মাঝামাঝিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া এক হিসাবে দেখা গেছে, সরকারি খাদ্যগুদামে মোট চালের মজুদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ লাখ টন। আবার ২০২১ সালের এপ্রিলের এক হিসাবে সরকারের গুদামে ১৫ লাখ টন চাল থাকার কথা থাকলেও ছিল মাত্র ৩ লাখের মতো। যে মজুদ আগের এক যুগের মধ্যে ছিল সর্বনিম্ন। চালের বড় এই ঘাটতি মোকাবিলায় তখন ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়।

আরও পড়ুনঃ  পিএসসির প্রশ্নফাঁস: ২ উপপরিচালক, গাড়িচালক আবেদ আলীসহ গ্রেপ্তার ১৭

গেল বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষি সেবা বিভাগের ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) ‘খাদ্যশস্য: বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী চাল আমদানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। ওপরে আছে শুধু চীন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ বাণিজ্যবছরে দেশে আমদানি করা হয়েছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল। তবে এফএও-এর ‘গ্লোবাল ফুড আউটলুক-জুন ২০২১’ প্রতিবেদনে বিশ্বে চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বাংলাদেশের তৃতীয় স্থান দখল করার কথা উল্লেখ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল চতুর্থ। চীন ও ভারতের পরেই তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়ার।

চাল উৎপাদনে দেশ যে স্বয়ংসম্পূর্ণ- দীর্ঘদিন ধরে এমনটা দাবি করে আসছে সরকারের বিভিন্ন মহল। সাধারণ জনগণও এমন দাবিতে অনেক আশাবাদী। খাদ্যপণ্যের দাম নাগালে আসবে এমন স্বপ্নই দেখতে শুরু করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বড় চাল আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। যদিও তাদের মতে সেটা ধারাবাহিক নয়, কোনো বছরে উৎপাদন কম হলেই আমদানির বিষয় সামনে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী আবার চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বাংলাদেশ আবারো তৃতীয় অবস্থানে ফিরে আসবে।

এক্ষেত্রে অনেকেরই প্রশ্ন, দেশে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ার পরেও চাল আমদানির প্রয়োজন কেন? এমন কৌতুহলের আংশিক উত্তর মেলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষণার ফলাফল থেকে। ব্রি বলছে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয়। এ ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা গেলে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন বাড়তি চাল পাওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ  রাঙামাটির আম যাচ্ছে যুক্তরাজ্য-ইতালিতে

তবে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে এই ব্যাখ্যা চালের অবচয় বা ক্ষতির বিপরীতে আমদানির পক্ষের যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে দেখা যায়নি সরকারের নীতিনির্ধারক কাউকে। এমনকি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যেও তার প্রমাণ পাওয়া গেল বিদায়ী বছরের ১ সেপ্টেম্বর ব্রি প্রণীত ‘বাংলাদেশে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণকরণ-ডিআরপি’ শীর্ষক কৌশলপত্র উপস্থাপন ও মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে। সেখানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সরকারের কৃষিখাত সংশ্লিষ্টরা চালের উৎপাদনের যে তথ্য দেয়, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বিশেষ করে চাল উৎপাদনের কোনো সঠিক তথ্য নেই।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, বিবিএসের মাথাপিছু চাল ভোগের পরিমাণ ধরে হিসাব করলে দেশে দুই কোটি ৮০ লাখ টনের বেশি চালের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে এর থেকে অনেক বেশি। তাহলে বাকি চাল গেল কোথায়? তারপরও কেন আমদানি করতে হচ্ছে? নিশ্চয় উৎপাদনের তথ্যে ভুল রয়েছে।’ অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী তথ্য তুলে ধরে বলেন, চীনে হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন ছয় টন, জাপানে পাঁচ টন, ভিয়েতনামের মতো অতি সাধারণ দেশে ৫ দশমিক ৮৪ টন হলেও আমাদের দেশে মাত্র ২ দশমিক ৭৪ টন। ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, আমরা চীন জাপানের মতো উন্নত নই সত্য, কিন্তু ভিয়েতনামের মতো ফলনও করতে পারি না।’

চালের বেশি উৎপাদন করেও আমদানি নির্ভরতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তথ্য ঘাটতিকেই এক নম্বর সমস্যা হিসেবে দেখিয়েছেন একুশে পদক পাওয়া কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান। তিনি এক সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছেন, আমরা বলি, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আমাদের কৃষি উৎপাদনও সেটাই বলে। তবে খাদ্য কিংবা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিবিএসের তথ্যে অমিল রয়েছে। তার পরামর্শ হচ্ছে, প্রকৃত উৎপাদন আর চাহিদার তথ্য না থাকলে ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করা খুবই কঠিন। চাল উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য আমাদের কাছে নেই, সেটা আগে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যা প্রকাশ করা হচ্ছে, সেটি সম্ভবত মনগড়া।

আরও পড়ুনঃ  দুই বছরেও চালু হয়নি বটুলি বর্ডার হাট

তবে ২০১৫ সাল থেকে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ- এমনটা দাবি করে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সরকারের বর্তমান লক্ষ্য পুষ্টিকর এবং মানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করতে জনগণ এবং কৃষকদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিদায়ী বছরের ২৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনের এক অধিবেশনে মন্ত্রী স্বীকার করেছেন, জনগণের আয় কমে যাওয়ায়, ক্রয় ক্ষমতার ওপর প্রভাব পড়েছে। খুচরা বাজারে মোটা চালের গড় দাম ১০ দশমিক ৮৯ ভাগ আর পাইকারি বাজারে যে ১০ ভাগ বেড়েছে সেটাও মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন।

অর্থনীতিবিদরা অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের পরেও অনেক সময় শুধু উচ্চমূল্যের কারণে বাজার থেকে খাদ্য কিনতে পারে না মানুষ। সেজন্য গরিব-ধনীর মধ্যে সম্পদ ও আয়ের ব্যবধান, মানসম্পন্ন ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত কঠিন করে তোলে। এখন খাদ্যের চড়া দামের মধ্যেও সরকার কীভাবে জনগণের জন্য পুষ্টিকর এবং মানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) ২০২১-এ। সেখানে দেখানো হয়, মানসম্পন্ন ও নিরাপদ খাদ্য বিভাগে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন