শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রডে গতিরোধ নির্মাণখাতে

রডে গতিরোধ নির্মাণখাতে

করোনা মহামারির প্রবল সংক্রমণে স্থবির হয়ে পড়েছিল সব ধরনের নির্মাণকাজ। এতে নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা কম থাকায় দামও ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে করোনার ভয়াবহতা কমে আসায় গোটা দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ গতিতে ছুটতে শুরু করেছে নির্মাণখাত। তবে গতি পাওয়া এই নির্মাণকাজে বর্তমানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্মাণখাতের সবচেয়ে জরুরি ও প্রধান উপকরণ রডের দাম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় রডের সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল। টন প্রতি বিক্রি হয়েছে ৮০ হাজার টাকায়। সেই রেকর্ডভাঙা দাম অতিক্রম করে বাজারে রডের দাম এখন ৮১ হাজার টাকা টন। যা আগে কখনও দেখা যায়নি। সে বিচারে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে রড।

দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামাল, স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে বেড়েছে তেল ও গ্যাসের দাম। পাশাপাশি জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে। সব মিলিয়ে রডের কাঁচামাল আমদানি করে আনতে বাড়তি অর্থ গুণতে হচ্ছে। মূলত এ কারণেই রডের দাম বেড়েছে। তাছাড়া করোনা মহামারীর ভয়াবহতার কারণে গেল প্রায় দেড় বছর নির্মাণকাজে ধীরগতি দেখা দিয়েছিল। এখন করোনার সংক্রমণ কমে আসায় নির্মাণকাজে গতি ফিরেছে। ফলে বাজারে ব্যাপক চাহিদা বেগেছে রডের। একদিকে স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে চাহিদা। এতে প্রভাব পড়েছে রডের দামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রডের কাঁচামাল আমদানি করে আনতে বাড়তি অর্থ ব্যয়ের কারণেই মূলত রডের দাম বেড়েছে।

বেশ কয়েকদিন ধরে বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে নির্মাণসামগ্রীর প্রধান উপকরণ রডের দাম। বাড়তে বাড়তে অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, এখন ভালো মানের ৭২ দশমিক ৫ গ্রেডের ( ৫০০ ডব্লিউ) একটন রডের দাম খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৮১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেচাকেনা হচ্ছে। এর আগে ওয়ান ইলেভেনের (২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর) সময় দেশজুড়ে দেখা দেওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে একটন রড বিক্রি হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

আরও পড়ুনঃ  নিবন্ধন পেল জুনায়েদ সাকীর গণসংহতি

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্মাণকাজের ভরা মৌসুমের কারণে সাধারণত রডের দাম বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বাড়ে। তবে এবার কয়েক মাসে আগ থেকেই দাম বাড়া শুরু হয়েছে। এখন যে হারে রডের দাম বাড়ছে তাতে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে এক টন রডের দাম ৯০ হাজার টাকা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রামের রড উৎপাদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে তুরস্ক, ব্রাজিল, ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রডের চাহিদা বেড়েছে। পাশাপাশি রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল বিলেট ও স্ক্র্যাপের দাম আকাশছোঁয়া। বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের বুকিং দর ১০০ ডলার বেড়ে তা ৬শ’ ডলারে ঠেকেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে আগে ৫০ হাজার টাকা টনে বিক্রি হওয়া স্ক্র্যাপ বর্তমানে ৫৪ থেকে ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিটন বিলেটে ৫ হাজার টাকা বেড়ে এখন ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে রড প্রস্তুতের খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন ভালো মানের বা ৭২ দশমিক ৫ গ্রেডের এক টন রড কোম্পানিভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭৭ থেকে ৮১ হাজার টাকা দরে। তাছাড়া মিলপ্রাইস (ল্যান্ডিংসহ) বিএসআরএম ৮০ হাজার ১৬০ টাকা, একেএস ৭৯ হাজার ৮৫০ টাকা, কেএসআরএম ৭৯ হাজার ৮৫০ টাকা, এসএআরএম ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা, এসসিআরএম ৭৮ হাজার টাকা, এইচএম স্টিল ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা, গোল্ডেন ৭৮ হাজার টাকা, জিপিএইচ ৭৯ হাজার ৩শ টাকা, আনোয়ার ৭৯ হাজার টাকা, মেট্রোসেম ৮০ হাজার টাকা, মেগনাম ৭৮৫০০ টাকা দরে বিক্রি করছে।

এদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এখন ৬০ গ্রেডের রড ৩২ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। খুচরা পর্যায়ে ৬০ গ্রেডের রড ৭৮ হাজার ৫শ থেকে ৮০ হাজার ৭শ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে, যা এক বছর আগে ছিল ৭৩ হাজার থেকে ৭৫ হাজার ৫শ টাকার মধ্যে।

আরও পড়ুনঃ  তারাকা‌ন্দিতে কমেছে সবজির দাম

নগরীর হালিশহর এলাকায় বহুতল ভবনের কাজ করছেন জিয়াউল হক সুমন। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। বাজেটের চেয়ে খরচ বেশি হওয়ায় নির্মাণকাজ বন্ধের উপক্রম হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ইস্পাত শিল্পে আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি লৌহজাত পণ্য প্রস্তুতে ব্যবহৃত কাঁচামাল, স্ক্র্যাপসহ উৎপাদনে ব্যবহৃত ইথানলসহ বিভিন্ন পণ্যেরও আগাম কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাই আমরা ভেবেছিলাম রডের দাম অন্তত কিছুটা কমবে। কিন্তু দোকানে টনপ্রতি চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেড়েছে রডের দাম। কোনো কোনো দোকানে ৮০ হাজার টাকাও দাম চেয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ খুব শঙ্কিত, নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।

চট্টগ্রামের সীমা অটো স্টিল মিলস লিমিটেডের পরিচালক পারভেজ উদ্দিন বলেন, রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। শুল্ক করও বেড়েছে। আবার রডের কেমিক্যাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই কেমিক্যালের দামও বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়েই এখন রডের দাম বেশি। এর আগে দেশের বাজারে রড এতো বেশি দামে বিক্রি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এর আগে কখনো এত দামে রড বিক্রি হতে দেখিনি। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সামনে রডের দাম আরও বাড়তে পারে।

বিএসআরএম-এর কোম্পানি সচিব শেখর রঞ্জন কর বলেন, আমাদের রডের দাম ৮০ হাজার টাকায় উঠেছে। এটাই দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এর আগে কখনো রডের এতো দাম হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম বাড়ার কারণে রডের দামও বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এখন স্ক্র্যাপ প্রায় ২০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সামনে রডের দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম বাড়লে সামনে দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। স্ক্র্যাপের দাম কমলে রডের দাম ধপ করে পড়ে যাবে। এটা সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করছে। তবে স্ক্র্যাপের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।

আরও পড়ুনঃ  শুল্কমুক্ত বাণিজ্য শুরু করবে বাংলাদেশ-ভূটান

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কৈয়্যুম চৌধুরী বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় আমাদের আবাসন ব্যবসায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গত ছয়মাসে নির্মাণসামগ্রীর দাম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। আমরা সরকারকে অনুরোধ করবো এ বিষয়ে সরকারকে একটা যুগপোযুগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সভাপতি প্রকৌশলী সফিকুল হক তালুকদার সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দেশের নির্মাণখাত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করে থাকে। নির্মাণশিল্পের মূল উপাদান এমএস রডসহ এ খাতের প্রায় সব প্রকার দ্রব্যাদির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে অনবরত বাড়ছে। শ্রেণিভেদে দ্রব্যের এ মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ।এছাড়া এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক মজুরিও প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের ব্যয়ও সে অনুপাতে বাড়বে। এমতাবস্থায় চলমান অস্বাভাবিক দাম বাড়ার প্রবণতা রোধ সম্ভব না হলে প্রকল্পের সব নির্মাণকাজে স্থবিরতা দেখা দেবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন