শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পনির শিল্পের বিকাশ কিশোরগঞ্জে

পনির শিল্পের বিকাশ কিশোরগঞ্জে
  • রাষ্ট্রপতির নির্দেশে শিল্প বিকাশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ
  • রফতানির সুযোগ সৃষ্টি

কিশোরগঞ্জে হাওর বেষ্টিত উপজেলা অষ্টগ্রাম। সেখানে ৩০০ বছরের আগে থেকে তৈরি হয়ে আসছে সুস্বাদু পনির। দেশ-বিদেশে প্রসিদ্ধ নির্ভেজাল ও নিরাপদ ও উপাদেয় এ খাবার সুনাম অর্জন করেছে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জের ব্র্যান্ডিং পণ্য পনির। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে এ শিল্পের বিকাশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি হাওরের অল-ওয়েদার সড়ক নির্মিত হওয়ায় পনির বিদেশে রফতানিরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

মোগল আমল থেকে পছন্দের তালিকায় স্থান ধরে রেখেছে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের সুস্বাদু পনির। গুণ ও মানে পনিরের পরিচিতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বময়। কোনো প্রকার ক্ষতিকর উপাদান ছাড়াই হাওরের গরু ও মহিষের বিশুদ্ধ দুধ থেকে স্থানীয় কারিগরদের তৈরি পনিরের কদর রয়েছে। বঙ্গভবন থেকে গণভবন, সব জায়গায় সবার পছন্দের খাবারের তালিকায় কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবার পনির। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে পনির। পাঠানো হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও। এরই মধ্যে জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে অষ্টগ্রামের পনির।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৩০০ বছর ধরেই অষ্টগ্রামে তৈরি হয় পনির। বংশ পরম্পরায় এ পেশায় জড়িত অষ্টগ্রাম সদরের অনেক কারিগর। তবে পর্যাপ্ত চাহিদা থাকার পরও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিন দিন কমছে পনিরের কারিগরের সংখ্যা। বর্তমানে মাত্র ২০টির মতো পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এদিকে হাওর-বাঁওড় মাছেভরা অষ্টগ্রামের পনির সেরা, এ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে হাওরের পনির। পনির তৈরির কারিগররা জানান, প্রতি ১০ লিটার দুধ থেকে তৈরি হয় এক কেজি পনির। বাজারে প্রতিকেজি পনির বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে। বর্তমানে অনলাইনেও বেড়েছে পনির বিক্রি।

আরও পড়ুনঃ  করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৭৮ লাখ ৪৯ হাজার মানুষ

জনশ্রুতি রয়েছে, কেবল কিশোরগঞ্জ, সিলেট বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে নয়, ঢাকাসহ সারাদেশের তৎকালীন নবাব ও জমিদার পরিবারগুলোতে পনিরের কদর ছিল। দিল্লির মোগল বাদশাহরা অষ্টগ্রামের পনির পছন্দ করতেন। এ পনিরের চাহিদা ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারেও। অষ্টগ্রাম কিশোরগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত হাওরে অবস্থিত একটি উপজেলা। এসব কারণেই পনির এখন কিশোরগঞ্জ জেলার অনন্য পরিচায়ক বা ব্র্যান্ড। তবে ঠিক কবে থেকে এ জনপদে অতি সুস্বাদু পনিরের উৎপাদন ও বিপণন শুরু হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য উদ্ধার করা যায় নি।

প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে এখানে আসে পাঠান-মোগলদের একটি দল। তারা অষ্টগ্রামের কাস্তুলে ছাউনি তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে অষ্টগ্রামের হাবিলি বাড়ি, বাজিতপুরের ভাগলপুর দেওয়ানবাড়ি, ইটনার দেওয়ানবাড়ি ও করিমগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে মোগলদের বসতি গড়ে ওঠে। এখনো এ অঞ্চলের বহু স্থানে তাদের বংশধর বা উত্তরসূরিরা আছে।

সে সময় কিশোরগঞ্জের সুপ্রাচীন থানা অষ্টগ্রাম ও এর আশপাশের বড় হাওরে স্থানীয় কৃষকরা মহিষ চরাতেন, ছিল গরু-মহিষের খামারও। এতে প্রচুর পরিমাণ দুধের যোগান ছিল। জনশ্রুতি আছে, একদিন কাস্তুলের ছাউনির কোনো এক মোগল পাঠান বড় হাওরে গিয়ে গরু-মহিষের পাল দেখে বিস্মিত হন। পাশাপাশি দুধের বিপুল উৎপাদন চোখে পড়ে তাঁর। কথিত আছে, ওই সময় স্থানীয়দের দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরি করতে দেখে তিনিও তাতে হাত লাগান। এভাবে ওই সেনাসদস্য একদিন নিজের অজ্ঞাতেই দুধের ছানা দিয়ে একধরনের নতুন খাবার তৈরি করে বসেন। পরে এর নাম রাখা হয় ‘পনির’। আবার অনেকে মনে করেন, এ খাবারের নামকরণ হয়েছে মোগলদের উত্তরসূরি কোনো এক দেওয়ান ‘পনির খাঁ’র নামানুসারে। দত্ত বংশীয় অভিজাত শ্রেণির এ দেশে আগমনের সঙ্গে পনিরের উৎপাদনের যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও অনেকের ধারণা।

আরও পড়ুনঃ  বাংলাদেশ জানুয়ারির মধ্যে করোনা ভ্যাকসিন পাবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

হাওরের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, শতাব্দীকাল আগে হাওরে বিচরণ করা মহিষের ওলান থেকে এত দুধ পাওয়া যেত যে, খেয়ে বা হাটে বিক্রি করে তা শেষ করা যেত না। তাই বাধ্য হয়েই মণ মণ দুধ ফেলে দিতে হতো। হাওরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রচলিত আছে, ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও’। কেবল যাতায়াতের দুর্ভোগের কারণে সে সময়ে উদ্বৃত্ত দুধ বাজারজাত করতে বাইরের এলাকায় পাঠানো যেত না। সে কারণেই হয়তো পনির তৈরির মাধ্যমে দুধ সংরক্ষণের বিষয়টি কারও মাথায় আসে।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জানান, হাওর এলাকার পর্যটক ও ভ্রাম্যমাণ পনির বিক্রয়কেন্দ্রগুলো এবং ট্যুরিস্টরা যেন অষ্টগ্রাম পনির নিয়ে যেতে পাওে সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আনন্দবাজার/এম.আর

সংবাদটি শেয়ার করুন