শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংকটেও সুতায় মুনাফা

করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে একের পর এক ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল হওয়ায় সুতা ও সুতা থেকে তৈরি কাপড়ের রফতানি ব্যাপকভাবে কমে আসে। তবে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় বর্তমানে সুতা ব্যবসায় খানিকটা সুবাতাস বইছে। বেড়েছে বিদেশি ত্রেতাদের ক্রয়াদেশ।

এতে সুতা ও সুতার কাপড়ের রফতানি আবারো বেড়ে গেছে। সেইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরেও বেচাবিক্রি আগের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। মূলত, চলতি বছরের শুরুর দিকেই অস্থির হয়ে পড়ে সুতার বাজার। এপ্রিল থেকে মে মাসে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছিল দামের পারদ। গেল কয়েক মাসে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সুতার বাজারের অস্থিরতা কমে এসেছে।

সূত্রমতে, পোশাকখাতের কাঁচামাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ৩০ কাউন্টের সুতার। যে সুতা বর্তমানে প্রতি কেজিতে ৪ ডলার ২৫ সেন্ট থেকে ৪ ডলার ৪০ সেন্ট দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গেল বছরের নভেম্বরে এই দাম ছিল ৩ ডলারেরও কম। পোশাকশিল্পের মালিকদের অভিযোগ, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্পিনিং মিলগুলো অন্যায্যভাবে সুতার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে কারখানাগুলোকে পোশাকের ক্রয়াদেশ নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে, বস্ত্রকলমালিকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বাড়তি। করোনা মহামারির কারণে কনটেইনার ভাড়াও বেড়েছে চার থেকে পাঁচ গুণ।

সুতার দাম বৃদ্ধি নিয়ে পোশাকশিল্পের মালিকদের কিছুটা ক্ষোভ আর অভিযোগের ফলে এক ধরণের চাপের মুখে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। এতে পোশাক ও বস্ত্রখাতের মালিকেরা একে অপরকে অভিযুক্ত করে কথা বলতে শুরু করেন। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন সুতার দাম বাড়ার ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, গেল কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার কাঁচামাল তুলার দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের মতো। এ কারণে বাধ্য হয়েই সুতার দাম বাড়াতে হয়েছে। কল মালিকদের কথা হচ্ছে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এককভাবে সুতার দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না।

আরও পড়ুনঃ  পর্যটনের শহর কক্সবাজার ধুকছে করোনায়

সূত্রমতে, প্রায় এক দশক আগে ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবরে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সে সময় তুলার দাম ছিল পাউন্ডপ্রতি ৭১ দশমিক ৪২ সেন্ট। চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর একই তুলার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাউন্ডপ্রতি এক ডলার ৬ সেন্টে। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দামের এই ঊর্ধ্বগতি উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে সংশ্লিষ্টখাতের ব্যবসায়ীদের।

তারা বলছেন, তুলার দাম বাড়া মানেই সুতার দাম বেড়ে যাওয়া। আর সুতার দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়ে পোশাকশিল্পে। তখন উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে পোশাকের দাম চড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে পোশাকখাতকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে। এক্ষেত্রে পোশাকশিল্প মালিকরা বলছেন, দেশি-বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশি পোশাকপণ্য বেশি দামে কিনতে রাজি নয়। এ অবস্থায় পোশাকখাতকে রফতানিমুখী হিসেবে স্থিতিশীল রাখতে হলে তুলার দাম স্থিতিশীল রাখা জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।

পোশাকখাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুতার দাম নিয়ে পোশাক ও বস্ত্রকলমালিকেরা পাল্টাপাল্টি অবস্থানে গেলে হিতে বিপরীত হবে। দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। প্রতিযোগী দেশগুলো সুযোগ লুফে নেবে। এমন পরিস্থিতিতে গত ২১ আগস্ট পোশাক ও বস্ত্র খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে সমঝোতা বৈঠক হয়। সেখানে পোশাক খাতের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ৩০ সিঙ্গেল কার্ডের প্রতি কেজি সুতার সর্বোচ্চ দাম চার ডলার ২০ সেন্ট নির্ধারণের মাধ্যমে বস্ত্রকল ও পোশাকমালিকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর ক্ষোভের প্রশমন ঘটেছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি পাউন্ট তুলার দাম ৮৫ ইউএস সেন্ট থেকে এক ডলারের মধ্যে থাকলে স্পিনাররা চার দশমিক ২০ ডলারে প্রতি কেজি ৩০ সিঙ্গেল কার্ডের সুতা বিক্রি করবে।

আরও পড়ুনঃ  ১০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নাকচ

এর আগে স্থানীয় বাজারে সুতার দাম বাড়ার কারণে টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) নেতাদের সঙ্গে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), টেরি টাওয়েল ও লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এতে গেল আগস্টের প্রথম সপ্তায় পোশাক প্রস্তুতকারক ও টেরি টাওয়েল ও লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্সের নেতারা সরকারকে চিঠি দেন। এতে সুতার দাম বাড়ার লাগাম টানতে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির শর্ত শিথিলের আবেদন জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য সংস্থাগুলো পৃথক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেও পরে তা বাতিল করে সংশ্লিষ্টখাতের নেতাদের মধ্যে বিদ্যমান সংকট সমাধানে আলোচনায় বসে।

মূলত, দেশের রফতানি আয়ের ৮১ ভাগের বেশি আসে তৈরি পোশাকখাত থেকে। যে খাতের প্রধান কাঁচামাল তুলা শতভাগ আমদানিনির্ভর। পোশাকখাতের বাইরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি হোম টেক্সটাইল খাতের প্রধান কাঁচামালও তুলা। স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো তুলা আমদানি করে তা থেকে উৎপাদিত সুতা বিক্রি করে নিটওয়্যার ও হোম টেক্সটাইল উৎপাদনকারীদের কাছে। যে কারণে তুলার দাম বাড়ার সঙ্গে পোশাকখাত ও খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসা ও শিল্পে তা সরাসরি প্রভাব ফেলে।

টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রফতানিমুখী নিট পোশাক কারখানার চাহিদার ৮০ ভাগ জোগান দেয় দেশীয় স্পিনিং মিলগুলো। ওভেন পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে সেটি ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ। ২০১৯ সালে স্পিনিং মিলগুলো ৩০৬ কোটি ডলার মূল্যের ১০ লাখ টন সুতা রফতানিকারকদের কাছে সরবরাহ করেছে। তবে কারোনার কারণে গেল বছরে তা কমে গিয়ে ৫ লাখ ৬৯ টনে দাঁড়ায়। অর্থের হিসাবে যার মূল্য ২৭৮ কোটি ডলার।

টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত ৪৫০টি স্পিনিং, ৮৫০টি উইভিং এবং ১৭০টি ডাইং ও ফিনিশিং কারখানা রয়েছে। স্পিনিং মিল সুতা তৈরি করে। আর উইভিংয়ে সুতা থেকে কাপড় বানায়। বস্ত্রখাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। তাতে নিট পোশাকের প্রয়োজনীয় সুতার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকের প্রয়োজনীয় কাপড়ের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে দেশীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলো।

আরও পড়ুনঃ  অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ধাক্কা

দাম বাড়া নিয়ে খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নানামুখী উদ্বেগ দেখা গেলেও চাপ আর সংকটের মধ্যেও সুতার ব্যবসায় মুনাফা আগের চেয়ে বেড়েছে। সাধারণত স্পিনিং মিল ২ থেকে ৩ ভাগ মুনাফা করলেও চলতি বছর ৫ থেকে ৬ ভাগ মুনাফা অর্জিত হয়েছে। কোনো কোনো মিল ১০ শতাংশও মুনাফা করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত ১০টি স্পিনিং মিলের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ৮টি স্পিনিং মিলেরই সুতা বিক্রি চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।

বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রফতানিমুখী মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিল গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১২ কোটি টাকার সুতা বিক্রি করেছিল। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে তাদের বিক্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ কোটি টাকায়। হিসাব করলে দেখা যায়, মিলটির বিক্রি বেড়েছে ২৩৯ শতাংশ। শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ২৪ পয়সা। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস ছিল দশমিক ৪২ শতাংশ।

পাশাপাশি করোনাভাইরাসের মধ্যেই বস্ত্র খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে। টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বেশ কয়েকটি স্পিনিং মিলসহ দেশে প্রায় ২০টি নতুন বস্ত্রকল স্থাপিত হচ্ছে। আবার ২০ থেকে ৩০টি পুরোনো বস্ত্রকলে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এতে আনুমানিক ২৫০ কোটি ডলারের নতুন বিনিয়োগ আসছে। ফলে আগামী দুই বছরে স্পিনিং খাতে ২০ লাখ স্পিন্ডল যোগ হবে। এতে সুতার বাজার যেমন সম্প্রসারিত হবে তেমনি কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন