রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পণ্য হাঁটলে দাম দৌড়ায়

পণ্য হাঁটলে দাম দৌড়ায়
  • নিত্যপণ্য: হাত বদলেই বাড়ে দাম
  • কেজিতে ৩ টাকা দাম বাড়তে বাড়তে ৩০ টাকা
  • স্থানভেদে দামে ফারাক কেজিতে ৩০ টাকা

দেশে নিত্যপণ্যের দাম স্থান আর কালের নীতি বড্ড বেশি অনুসরণ করে। পণ্য হাঁটলেই দামের ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করে। নিত্যপণ্যের বাজারের এই বৈশিষ্ট্যের কোনো বদল ঘটে না। উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছা অবধি দামের এই ফারাক অবিশ্বাস্য।

এতে যিনি উৎপাদন করেন তিনিই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হন। আর যারা মধ্যবর্তীতে থাকে তারাই সবচেয়ে মুনাফা তুলে নেন। দামের অবিশ্বাস্য এই ফারাকের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক পর্যায়ের চাষী বা উৎপাদনকারী। পণ্যের ন্যায্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে যত উপায়ই অবলম্বন করা হোক না কেন শেষ অবধি উৎপাদক পর্যায়ে সেই সুবিধা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় না।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে কোনো সমন্বয় নেই। বাজারের সঙ্গে সমন্বয় নেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যেও। বেশিরভাগ নিত্যপণ্যেল দামেই ব্যাপক ফারাক দেখা যায়। তাছাড়া ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) দামেও কোনো সমতা থাকে না। ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছুতে কোন পণ্যের দাম কতটুকু বাড়বে বা কোন পর্যন্ত দামে সীমাবদ্ধ থাকবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। দেখা যায়, রংপুর থেকে আসা পণ্য রাজধানীর এক বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজিতে। সেই পণ্যই আবার অন্য বাজারে ৩৫ টাকায় বেচাকেনা চলছে। যা ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছে দাম গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৪০ টাকা। আবার কোনো কোনো পণ্য দেশের এক বিভাগ থেকে অন্যবিভাগে দাম চড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে।

পণ্যের দামের এই ফারাক নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা নেই অনেকের কাছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কাঁচাবাজারে দামের স্থিতিশীলতা কম। যেসব পণ্যের স্থায়িত্ব কম সেসব পণ্যের দামের ক্ষেত্রেও অস্থিরতা থাকে। বিশেষ করে স্থান কাল ভেদে বড় ফারাক হয়ে থাকে দামে। দেশের সাতটি বিভাগের নিত্যপণ্যের দাম যাচাই করতে গিয়ে এমন চিত্র উঠে এসেছে আনন্দবাজারের অনুসন্ধানে।

জীবনযাপনে অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন ১৮টি নিত্যপণ্য কোন বিভাগে কত টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে সে ব্যাপারে গতকাল শুক্রবার আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পণ্যের এসব দাম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ফারাক উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত কেজি প্রতি ৩ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কম বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফারাক দেখা গেছে গরুর মাংসের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন বিভাগের গরুর মাংসের দামের এই ফারাক প্রায় ৮০ টাকা পর্যন্ত।

আরও পড়ুনঃ  ভ্যাকসিন জুন-জুলাইয়ের আগে রফতানির সম্ভাবনা নেই: সেরাম

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পণ্য পরিবহন আর সহজলভ্যতার ভিত্তিতেই দাম চড়ে যায় কিংবা কমে আসে। তবে দামের অত্যধিক ফারাক অস্বাভাবিক। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে দামের সমন্বয় করতে হবে। তাছাড়া পরিবহন সুবিধার কারণে ‍উৎপাদক পর্য়ন্ত দাম যে ন্যায্যা হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বেঁধে দেয়া দামের মধ্যে মোটা চাল ৪৮ টাকা কেজি, চিকন চাল ৭০, আটা ৩৫, মসুর ডাল (দেশি) ১১০, মসুর ডাল (আমদানি) ৯০, সয়াবিন তেল ১৪২, পেঁয়াজ ৬২, রসুন ৭০, কাঁচামরিচ ৭০, রুই মাছ ৩৫০, ইলিশ ১৩০০, গরুর মাংস ৬০০, ব্রয়লার মুরগি ১৬০, দেশি মুরগি ৪৬০, ডিম ৩৫ টাকায় বিক্রি করার কথা। তবে দেশের আট বিভাগের খুচরা বা পাইকারী বাজারে বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দাম রাখা হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, মোটা চাল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও একই চাল রংপুরে ৬২, ময়মনসিংহে ৪৬ এবং সিলেটে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে দামে প্রায় ১৪ টাকা পার্থক্য দেখা যায়। আবার ঢাকায় চিকন চাল (নাজিশাইল) ৭০ টাকায় বিক্রি হলেও একই চাল চট্টগ্রামে ৬২ টাকা, রাজশাহী ৬০ টাকা, খুলনায় ৬৫, রবিশালে ৬২, সিলেটে ৬৮, রংপুরে ৭০ ও ময়মনসিংহে ৬৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে বিভাগবিভিত্তিক দামের এই ফারাক ৮ থেকে ১০ টাকা অবধি।

মসুরের ডাল দেশিটার দাম ঢাকায় ১২০, চট্টগ্রামে ১৩০, রাজশাহীতে ১১০, খুলনায় ১১০, রবিশালে ১১০, সিলেটে ১০৫, রংপুরে ৯০ ও ময়মনসিংহে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে দেখা যায় মসুর ডাল বিভাগে ১০ টাকার পার্থক্য রয়েছে। আবার আমদানি করা মসুর ডাল ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজিতে। সেই মসুর রাজশাহী, রবিশাল ও ময়মনসিংহে ৯০ টাকা, খুলনায় ৮০, সিলেটে ৮৫, রংপুরে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আট বিভাগের মধ্যে দামের ফারাক ১৫ টাকা পর্যন্ত।

আরও পড়ুনঃ  নিলামে আট বছরে সর্বোচ্চে দুগ্ধপণ্যে

এদিকে, সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ঢাকায় লিটারে ১৭০ টাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে ১৬০, রাজশাহী ১৬০, খুলনা ও রবিশালে ১৫৫, সিলেট ১৬৫, রংপুরে ১৪৫ টাকায়। স্থান ভেদে সয়াবিন তেলে লিটার প্রতি ২৫ টাকার পার্থক্য।

হোটেল, রেস্তোঁরাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখলে রেখেছে ব্রয়লার মুরগির মাংস। দেশের বিভাগগুলোতে এটির দামেও বিশাল ফারাক দেখা গেছে। ঢাকায় ১৭০ টাকা কেজি, চট্টগ্রাম ১৫৫, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও খুলনায় ১৫০, সিলেট ১৬০, রংপুরে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের দাম চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি। সেখানে ৬২০ কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকা ও ময়মনসিংহে ৬০০, খুলনা ৫৮০, সিলেট ও রংপুরে ৫৫০ টাকা।

হল্যান্ডের আলু ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এতে দামে ৫ টাকার মতো ব্যবধান রয়েছে দেশব্যাপী। পেঁয়াজ সবচেয়ে কম দাম চট্টগ্রামে ৪৫ ও সবচেয়ে বেশি রংপুরে ৭০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে গ্রাহকদের। কাঁচামরিচের ঝাল ময়মনসিংহে বেশি। সেখানে ১০০ টাকা কেজি ও চট্টগ্রামে ৫০ টাকা। রুই মাছ সবচেয়ে কম দাম ময়মনসিংহে। সেখানে এক কেজির রুই ২২০ ও ঢাকায় ৩৪০ টাকায় বিক্রি করছেন পাইকাররা। ইলিশ মাছ ময়মনসিংহে ১১০০ টাকা আর ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ টাকাতে।

চিনির দামেও বেশ ফারাক দেখা যায়। রংপুরে প্রতি কেজিতে চিনি ৯০, ময়মনসিংহে ৮০, ঢাকায় ৬৫ ও অন্যান্য বিভাগে ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে দামের পার্থক্য ২৮ টাকার মতো। ডিম ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ঢাকায় ৩২ টাকা হলেও রংপুরে ৩৫ টাকা হালি। এতে ময়মনসিংহের চেয়েও ৩ টাকা বেশি রংপুরে।

আরও পড়ুনঃ  নাব্যতা সংকটে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ফেরি চলাচল বন্ধ

বরিশাল বিভাগের বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের দামের তথ্য দিয়েছেন হাসিবুল ইসলাম। তার দেয়া তথ্যমতে, সেখানকার বাজারে ফুলকপি ৫০ টাকা কেজি, বাঁধাকপি ৩০, টমেটো ১৫০, শালগম ৫০, বেগুন ৪০, পটল ৪০, মুলা ৩০, বরবটি ৭০, চিচিঙ্গা ৪০, করলা ৬০, ঝিঙ্গে ৪০, শিম ৫০, পেঁপে ২৫, শসা ৩০, ধনেপাতা ১২০, কাঁচা মরিচ ৮০, চাল কুমড়া ৪০ ও মিষ্টি কুমড়া ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশি আঁদা ৮০, চায়না আদা ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজশাহীর বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের দামের তথ্য জানিয়েছেন উপল আরাফাত। সেই তথ্যমতে, সেখানকার সবজির মধ্যে প্রতি কেজি শিম ৬০ টাকা, করলা ৪০ টাকা, ঢেড়শ ৩০ টাকা, বেগুন ৪০ টাকা, পাতাকপি ৬০ টাকা, ফুলকপি ৫০ টাকা, পটল ২০ টাকা, মূলা ২০ টাকা, বঁরবটি ৪০ টাকা, কুমড়া প্রতি পিস ২০ থেকে ৩০ টাকা, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৮০ টাকা, আলু ২০ টাকা, পেঁয়াজ ৬০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, রসুন ৫০ টাকা, আদা ৮০ টাকা কেজি।

মসলার বাজারে প্রতি কেজি জিরা ৩২০ টাকা, তেজপাতা ২০০ টাকা, এলাচ ২ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা, ডালচিনি ৪০০ টাকা, লং এক হাজার ২০০ টাকা। মটর ডাল ৫০ টাকা, মাসকালাই ১৩০ টাকা, মুগ ১০০ টাকা, খেসাড়ি ৬০ টাকা। মাছের মধ্যে চিংড়ি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, পাঙ্গাস ১০০ থেকে ১২০ টাকা, বড় সিলভার কার্প (৩ থেকে ৫ কেজি) ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, মাঝারি সিলভার কার্প (দেড় থেকে আড়াই কেজি) ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সিলেটের ভোক্তা রঞ্জিত বলেন, দামের পার্থক্য তাদের বিভাগে একটু বেশি। কেননা এখানকার অনেক মানুষ বিদেশে থাকে। তারা বেহিসাবে টাকা ব্যয় করে। মিশন নামের আরেকজন বলেন, সিলেটের মানুষের খরচ কোনোভাবেই রাজধানী ঢাকার চেয়ে কম নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশিই হয়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন