শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নাটোরের বস খেজুরের রস

নাটোরের বস খেজুরের রস

গ্রাম বাংলার ইতিহ্যবাহী খেজুরের রস আর পাটালি গুড়ের চাহিদা এখন দেশ জুড়ে। দেশে এক নামে পরিচিত ‘নাটোরের বস, খেজুরের রস’ । শীতের শুরু থেকেই খেজুরের রস আর পাটালি গুড়ের জন্যে দেশ বিদেশের বাঙালিরা হন্যে হয়ে থাকে একটু স্বাদ আর গন্ধ পেতে।

শীতের শুরুতেই এই রসনা তৃপ্তি মেটাতে শহরে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের মিলন মেলাও বসছে গ্রামের বাড়িতে। শীতের পিঠা-পায়েস খাওয়া আর আড্ডায় জমে উঠছে গ্রামীণ অঞ্চল।

খেজুরের পাটালী গুড় শুধু গ্রামেই নয় এর চাহিদা এখন দেশ ছেড়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন উদ্যোক্তাদের কল্যাণে। এছাড়া স্থানীয় বাজারেও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। বিক্রিও হচ্ছে চোখে পরার মতো। ব্যাপক চাহিদা থাকায় দেশের বিভিন্ন শহর থেকে ছুটে আসছে ব্যাপারী ও পাইকারি ক্রেতারাও।

যদিও গাছের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কম, গাছিদের অনাগ্রহ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে কিছুটা ভাটা পড়েছে এই কুটিরশিল্পে। তবুও সংকটের মধ্যেও নাটোরের খেজুরের রস আর পাটালি গুড়ের উৎপাদন ও বেচাকেনা চলছে বেশ ভালোই। নাটোরের বিভিন্ন হাট বাজার ঘুরে দেখা যায় খেজুরের রস আর পাটালী গুড়ের কদর। জ্বালানি সংকটের কারণে দাম একটু বেশি হলেও কদর কিন্তু কমেনি এক চিলতেও। তাই গাছিরা এখনো ধরে রেখেছেন তাদের পুরনো এই পেশাকে।

নাটোর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, নাটোর সদরসহ ছয়টি উপজেলার ৪৮ হেক্টর জমিতে প্রায় সাত লাখ ৯১ হাজার ৫১৪টি খেজুরগাছ রয়েছে। শীত মৌসুমে এসব গাছ থেকে ১১ হাজার ৫২০ টন গুড় উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় থেকে পৌনে ২ কোটি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, বাগাতিপাড়া উপজেলায়। গত বছর জেলায় চার হাজার ৬৪ টন গুড়-পাটালি ও প্রায় দুই হাজার ৫৬০ টন রস উৎপাদন হয়েছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এসব পাটালি গুড় যাচ্ছে দেশের অন্যান্য জেলাতেও।

আরও পড়ুনঃ  ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

গুড়ের উৎপাদন বেশি হওয়ায় নাটোরের বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে উঠেছে আড়ৎ। নাটোর সদর উপজেলার স্টেশন বাজার, বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া বাজার, লালপুর বাজার, সিংড়া, নলডাঙ্গা, বাগাতিপাড়া ও গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় এলাকায় রয়েছে এসব আড়ত। দেশের বিভিন্ন স্থানে নাটোরের তৈরি খেজুরের গুড়ের রয়েছে বিশেষ চাহিদা ছাপিয়ে এখন বিদেশেও যাচ্ছে এসব গুড়।

নাটোরের পাটালির সুঘ্রাণ যশ বা খ্যাতি গুড়ের সন্দেশ, ক্ষীর-পায়েস সব কিছুতেই অন্যন্যতার ছোঁয়ায় দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন যাচ্ছে বিদেশেও। এবছর থেকে নাটোরের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে গুড় বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বাজার কিছুটা সম্প্রসারণ হচ্ছে।

নাটোরের বড়াইগ্রামে উপজেলার মৌখাড়া বাজারের ‘সুহার ঝুড়ি’ অনলাইন/অফ লাইন উদ্যোক্তা সুহা মনি জানান, গত বছর বড়াইগ্রামের ৩০ জন গাছির সঙ্গে চুক্তি করেছিলাম। তাদের তৈরি ৪ টন পাটালি এবং বাটি গুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেছি। স্থানীয় বাজারের তুলনায় দাম বেশি দিয়েছি। নির্ভেজাল পণ্যের চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম বেশি ছিল। ক্রেতাদের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এবার দেশের পাশাপাশি অনলাইনে বিদেশ থেকেও আসছে গুড়ের অর্ডার। গত বছরের তুলনায় এবার দ্বিগুণ টার্গেট করছি। পাটালি গুড়ের বাজার সম্প্রসারণ করতে পারলে গাছিরা দাম বেশি পাবে।

নাটোরের গুরুদাসপুর এলাকার গাছি রিয়াজ উদ্দিন (৪৫) বলেন, ঝুঁকি নিয়ে গাছ কাটতে হয়। ভোরে গাছ থেকে রস নামানো খুব কঠিন কাজ। এরপর জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি করে বিক্রি করতে হয়। এতো কষ্ট করার পরও ভাল দাম পেলেও জালাণীর দাম বৃদ্ধিতে কিছুটা ভাটা পরেছে ব্যবসায়। এবছর “আমার ৭০টি খেজুর গাছ আছে। প্রতিদিন ১৫টি করে গাছ কাটি আমি। ৮ থেকে ভাড় রস হয়। এখন বেশিরভাগ দিনই কাঁচারস বিক্রি করি। কারণ কাচা রসেই বেশি লাভ। কোনো খরচ ছাড়াই ৫০ থেকে ৬০ টাকা লিটার রস বিক্রি হয়। এখন এলাকায় পিঠা পায়েসের উৎসব চলছে।

আরও পড়ুনঃ  ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস

গুরুদাসপুরের বাণিজ্যনগরী চাঁচকৈড় হাটার বিভিন্ন আড়তে গিয়ে দেখাযায় কেজিপ্রতি পাটালি গুড় ১২০ থেকে ১২৫ টাকা দানাগুড় ১০০ থেকে ১১০ এবং লালী গুড় ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গুরুদাসপুরের ধারাবারিষা এলাকার সালাম শেখ জানান, শহর থেকে এক ছেলে ও দুই মেয়ে আর নাতি-পুতি এসেছিল। পিঠা উৎসব শেষে যাওয়ার সময় তারা ৫ কেজি করে পাটালি নিয়ে গেছে। ছোটমেয়েকে একটু বেশি দিলাম সে অনেক দুরে(চট্রগ্রাম) থাকে। বছর শেষে এক সাথে নাতি-পুতিদের কাছে পেয়ে অনেক ভালো লেগেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নাটোরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, নাটোরের ঐতিহ্য খেজুর গাছ এখন কমে গেছে। সরকারিভাবে খেজুর গাছ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খেজুরের গুড় উৎপাদনে নাটোর বিখ্যাত। এই জেলার গুড়ের সুনাম ও চাহিদা রয়েছে দেশ ব্যাপি। খেজুর গুড়কে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন