শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডলারের স্বপ্ন প্লাস্টিক পণ্যে

ডলারের স্বপ্ন প্লাস্টিক পণ্যে

দেশের বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের তালিকায় ১২তম

  • প্রয়োজন নীতিসহায়তাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা

প্লাস্টিককে সমস্যা না মনে করে সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে পরিবর্তন করা সম্ভব। এটি নষ্ট না করে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে দেশীয় বাজার সমৃদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ডলার আয় করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন নীতিসহায়তাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা। কেননা এখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের ১২তম স্থানে উন্নীত হয়েছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য।

টেকসই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নীতি প্রণয়ন (এনাব্লিং পলিসি ফর সাস্টেইনেবল প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট) শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন ড. ইজাজ হোসাইন। গতকাল শনিবার বেলা ১১টায় রাজধানী ঢাকার বনানীস্থ হোটেল শেরাটনে সেমিনারটির আয়োজন করে দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)।

মূলপ্রবন্ধে বাংলাদেশ প্রকৌশ বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন ড. প্রফেসর এজাজ হোসাইন বলেন, ঢাকায় জনপ্রতি ৯ কেজি করে প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। ২০১৯ সালে দেশে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। তারমধ্যে  ল্যান্ডফিলে গেছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭৪০ টন তথা ৩৯ ভাগ, নদীতে গেছে ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮৫ টন তথা ২৫ শতাংশ এবং ২ লাখ ৯৩ হাজার ৮২৫ টন রিসাইকেল করা হয়েছে যা ৩৬ ভাগ। জিডিপি বাড়লে প্লাস্টিকের অপব্যবহারও বাড়বে।

ড. প্রফেসর এজাজ হোসাইন আরও বলেন, এখন গাড়ির বডি প্লাস্টিকে তৈরি হচ্ছে। ময়লা হয়ে গেলেও এটিকে কাজে লাগানো সম্ভব। ২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের বাজার ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকার। আর ২০২২ অর্থবছরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে বিদেশে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করে। এটি রপ্তানিখাতে ১২তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে।

ড. এজাজ বলেন, দেশে ৫ হাজার পাঁচশত প্লাস্টিক কারখানায় ২০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। ভারতে ২০১০ সালের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১০০ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে ৯৮ ভাগই তারা সংগ্রহ করে থাকে। তারা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা জরিমানা করেছিল মমতা ব্যানর্জিকে প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে। দেশটির ইনডোর শহর ২০২০, ২১ ও ২২ সালে ক্লিন সিটি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। সুরাত, মুম্বাই, নিউ দিল্লিসহ ১০টি শহরে এর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  রেকর্ড গড়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন

তারা প্লাস্টিক পণ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা করে পুনরায় উৎপাদন ও ব্যবহার করছে। কোনো ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন পণ্য নষ্ট না করে আবার প্রসেসিং করে ব্যবহার করছে। তা ছাড়া সিঙ্গাপুর প্যাকেজিং এগ্রিমেন্ট-এসপিএ ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করে। তারা বিভিন্নস্থানে কি পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করা যাবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সে অনুযায়ী প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য বাসায় আলাদা করে রাখলে ভালো হয়।

তাছাড়া তিনভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করা যায়। ১. রিডিজাইন ৩০ শতাংশ, ২. রিফিউজ ২০ শতাংশ ও ৩. রিসাইক্লিং ৫০ শতাংশ করা সম্ভব। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় (রিফিউজ ডিরাইভেড ফুয়েল-আরডিএফ) ১.৫ মিলিয়ন টন আরডিএফ, ঢাকা সারাদেশের ১৫ শতাংশ বর্জ্য তথা ২২ লাখ ৫ হাজার টন ঢাকাতেই হয়ে থাকে। কোকা কোলা কোম্পানি তাদের প্লাস্টিকের ২০ শতাংশ ফেরত নিয়ে আসছে। প্লাস্টিক থেকে তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব পাওয়ার টিলারে ব্যবহারযোগ্য।

শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে শিল্পায়ন হচ্ছে। রোডম্যাপ সামনে আছে। ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েট হচ্ছে। প্লাস্টিক পণ্য এসডিজি অর্জনে সহায়তা করবে। ২০৩১ সালে বাংলাদেশে কি ধরনের প্লাস্টিক তৈরি হবে সে বিষয়ে ইতিপূর্বে একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ঢাকায় বছরে জনপ্রতি ১৩-১৪ ও গ্রামে ১০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। এটি ২০৩৫ সালে ৩৫ বা ৩০ কেজিতে গিয়ে দাঁড়াবে।

এফবিসিসিআই’র সভাপতি বলেন, বাংলাদেশের গ্রোথ আছে, থাকবে। প্লাস্টিকের ওয়েস্টেজ ৮০  কেজি, আমেরিকা, সিঙ্গাপুরে ১০০ কেজির ওপরে। ইউরোপ-আমেরিকার রিসাইকেল করছে আর আমরা বন্ধ করতে চাচ্ছি। ২০০০ সালে এটি বন্ধ করতে আইন হয়েছিল কিন্তু কোথাও বন্ধ হয়নি। বর্তমানে আমাদের নদী ও সমুদ্রে যে প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে তা ভারত, চীন থেকে চলে আসছে। এসব দেখার লোক নেই। আমরা নিজেরা সচেতন না হলে আগামীতে পস্তাতে হবে। তা ছাড়া এই তিনভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার করা যায়। যথা ১. রিসাইকেল, ২. রি-ইউজ, ৩. রিফিউজ করার মাধ্যমে এটিতে সমন্বয় করা যায়। আমরা ওয়াল মার্টের কাছে হেঙ্গার রপ্তানি করি। তারা ৯০ ভাগ প্রকৃতি সম্মত প্লাস্টিক চাচ্ছে যা দিতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  রাজধানীতে যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকা

সভাপতি বলেন, গৃহস্থালীর ময়লা আলাদা করে ফেললে সিটি করপোরেশন ময়লা নিতে পারে। প্লাস্টিকের বর্জ্য ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা যায়। এখানে সিটি করপোরেশন পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এলিট তথা ধনীকশ্রেণি দেশিয় পণ্য কিনে না। ইউনিয়ন পর্যায়ে ময়লা কোথায় ফেলবে তা নির্ধারণ করতে হবে। কেননা পানি দূষিত হচ্ছে ও স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সচেতন হলে প্লাস্টিকের ওয়েস্টিজ কমানো সম্ভবয়। ইউরোপে হোটেলগুলো গ্লাস ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে। আইন করতে হবে ব্যবহারযোগ্য। এক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা এখন ব্যবসায়ীরা হালাল তথা সৎভাবে ব্যবসা করতে চায়। পরিবেশকে বাঁচিয়ে ব্যবসা করতে হবে। সরকারের সোনালি ব্যাগের প্রোডাকশনে প্রচুর অর্থ ব্যয় হলেও আলোর মুখ দেখেনি। আমরা বার বার প্রস্তাব রেখেছি বেসরকারি পর্যায়ে অর্থায়নের কিন্তু ফিডব্যাক নেই।

ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের সিইও এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাভেদ আকতার বলেন, প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের কাছে পণ্য রপ্তানি করা বেশি সম্ভব হয়েছে। প্লাস্টিককে শত্রু হলেও প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট হলে এটি শত্রু নয়। এক্ষেত্রে রিউইং দ্যা সিস্টেম, রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেনট, রি প্যাকেজিং করতে হবে। তিনি বলেন, প্লাস্টিকের মান ঠিক রেখে কাজ করলে ফেক্টরিতে ব্যবহার করা যায়। বর্জ্যসংগ্রাহকদের অর্থনীতি বৃদ্ধি পায়। ইউনিলিভার ১৬শ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেছে। বছরে ৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে। এখন পৌরসভা পর্যায়ে সহযোগিতা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক গোডস মেনুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, হাসপাতালের প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হয়। কারখানাগুলোতে ৫০ ভাগ বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার হয় ও কোন বর্জ্য বাইরে বের হয় না। এটি অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়। ২০০৫ সালে ৩ কেজি থেকে ৯ কেজি উন্নীত হয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার ৩ বছরে। ২০২১ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জে প্লাস্টিক রিসাইকেলিং করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  টপটেন গেইনারে শতভাগ, লুজারে ৬০ শতাংশ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. মাঈনুল ইসলাম  বলেন, এখন পর্যন্ত ৫শ টন প্লাস্টিক বর্জ্যসংগ্রহ করে দেড়শ টন বিক্রি করা হয়েছে। এ কাজে ৫ শতাধিক লোক জড়িত এখানে। তাদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা হয়েছে। ৬শ টন প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে ৬ মেগায়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে। ১৯৭৯ সালে দেশে প্রথম প্লাস্টিক আমদানি শুরু হয়।

বাংলাদেশ পেট্রোক্যামিকেল কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এন্ড সিইও খাদেম মাহমুদ ইউসুফ বলেন, আমরা ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং করেছি। ভাঙারিদের ক্যাশে অর্থ দিতে হয় বলে দাদনের মুখে পড়তে হয়। এটিতে ৪ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বর্জ্য ও রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক রোজিনা বেগম বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদী প্লাস্টিক নিয়ে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় পরিবেশ আদালত আছে যদিও প্লাস্টিক বিষয়ে কোন কাজ এখনো করা হয়নি। তা ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রামে তিনটি ট্রাইব্যুনাল আছে পরিবেশ বিষয়ে।

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন