বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডিমের উৎপাদনেই সংকট

ডিমের উৎপাদনেই সংকট

ডিমের দাম বৃদ্ধিতে খামারিদের দায় নিয়ে দু’দিন আগে কথা হয়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে পোল্ট্রি ফার্ম গড়ে তোলা তরুণ উদ্যোক্তা আজহারুল ইসলাম সোহেলের সঙ্গে। বলেছিলেন, ফিডের অতিরিক্ত দাম, ভ্যাক্সিন, বিদ্যুৎ, পরিবহন, শ্রমিক খরচ বাদ দিলে বেশি লাভ থাকে পোল্ট্রিখাতে। জানিয়েছিলেন, আগে লোকসান দিলেও ডিমের দাম বাড়ার কারণে কিছুটা লাভ হচ্ছে। তার সেই বক্তব্য গত বুধবার দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত ‘প্রোটিনের লাগাম ডিম’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।

তবে গতকাল বৃহস্পতিবার তরুণ উদ্যোক্তা সোহেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খানিকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। মন্তব্য নেয়ার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন, আপনারা তো ডিমের বাজার নামিয়ে দিলেন! সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত তো করতেই পারলেন না, উল্টো ছোট খামারিদের পেটে আঘাত করলেন। আগেই তো বলেছি, ডিমের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে আমাদের মতো ছোট খামারিদের কোনো দায় নেই। আমরা তো পরিস্থিতির শিকার।

তরুণ উদ্যোক্তা সোহেল আক্ষেপ নিয়ে বললেন, কয়েকদিন ডিমের ভালো বাজার পাওয়া গিয়েছিল। ভাবছিলাম, এবার উঠে দাঁড়াতে পারবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সরকার আমদানির হুমকি দিয়ে সব পণ্ড করে দিলেন। একদিনেই দাম নেমে গেছে হালিতে পাঁচ টাকা করে। ফিডের দাম, পরিবহন, ভ্যাক্সিন, বিদ্যুৎ, শ্রমিক যাই বলেন না কেন, উৎপাদন খরচ কিন্তু কমছে না। ডিমের দাম কমে যাওয়া মানে আমার মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আবারও অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হবে।

সোহেল তার খামারে পালন করেন এক হাজারের মতো মুরগি। উদ্যোগ শুরু করতে তাকে যে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে সেটা তিনি হিসাবেই ধরেননি। তার খামারের শেড তৈরিতে খরচ পড়েছে ৪ লাখ টাকার মতো। খাঁচা তৈরিতে বিনিয়োগ করেছেন দুই লাখ টাকা। মুরগির বাচ্চা কেনা থেকে থেকে শুরু ডিম দেয়া পর্যন্ত তার খরচ হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টাকার বেশি।

সোহেলের খামারের হিসাব অনুযায়ী, তার এক হাজার মুরগীর পেছনে প্রতিদিনের খরচ ৭ হাজার ৪৪০ টাকা। ফিড ১২০ কেজির দাম ৬৮৪০ টাকা। শ্রমিক খরচ ৩০০ টাকা আর বিদ্যুৎ বাবদ খরচ একশ টাকার মতো। প্রতিদিন ওধুষের প্রয়োজন না থাকলেও গড়ে একশ টাকা খরচ রাখতে হয়। আর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শেড তুলতে প্রতিদিন গড়ে একশ টাকা খরচ হয়।

সোহেলের হিসাব মতে, প্রাথমিকভাবে একশ মুরগিতে ডিম পাওয়া যায় ৯০ ভাগ। এরপর আস্তে আস্তে তা কমে আসে। শেষ অবধি একশ মুরগি থেকে গড়ে প্রতিদিন ৮৫ ডিম পাওয়া যায়। চলমান বাজার অনুযায়ী উৎপাদন ৯০ ভাগ থাকলে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে নয় হাজার টাকার মতো আসে। এর মধ্যে থেকে উৎপাদন খরচ ৭ হাজার ৪৪০ টাকা বাদ দিলে তার লাভ হয় দুই হাজার টাকার মতো। তবে অবকাঠামো ও খাচাঘর তৈরিসহ প্রায় দেড় বছরের অতিরিক্ত ব্যয় বাদ দিলে প্রকৃত লাভ আরও কমে যায়।

আরও পড়ুনঃ  পাকিস্তান থেকে সরাসরি ভারতের আজমেরেতে পঙ্গপালের হানা

সোহেল বলেন, খামারে ৮৫ ভাগ ডিম উৎপাদনে লাভের মুখ দেখা সহজ নয়। কাচামাল বিচারে ডিমের দাম হঠাৎ কমে, হঠাৎ বাড়ে। অথচ ফিড বা পরিবহন খরচ সব সময়ই ঊর্ধ্বমুখ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভুট্টা আমদানি কমে যাওয়ায় পোল্ট্রি ফিডের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। আগের বছর ৫০ কেজির যে ফিড ছিল ১৭০০ টাকা, সেটা এক লাফে বেড়ে হয়েছে ২৮০০ টাকা। ফলে খামারিদের লাভের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।

এদিকে, হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়া ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি প্রয়োজনে ডিম আমদানির ঘোষণা দিয়ে বসেছেন। এতে পরদিন বৃহস্পতিবার এক লাফে প্রতি হালিতে ৫ টাকা করে দাম কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে শঙ্কায় পড়েছেন দেশের ক্ষুদ্র খামারিরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খামারি শঙ্কা প্রকাশ করে দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমাদের ভয় হচ্ছে ডিমের বাজার কখনও না চলে যায় ভারতের কবলে। ভারত থেকে সাদা ডিম আনলে মুরগির বদলে আসবে কচ্ছপের ডিম। কারণ দেশটির সামুদ্রিক বেশকিছু অঞ্চলে কচ্ছপের প্রচুর ডিম পাওয়া যায়। যেগুলোকে মুরগির ডিম থেকে আলাদা করা খুবই কঠিন। আকারে আর ওজনে দুই ধরনের ডিম একই। আমদানির সুযোগে দেশের মানুষের পাতে মুরগির ডিমের বদলে থাকবে কচ্ছপের ডিম।

জালাল উদ্দিন নামের কিশোরগঞ্জের খামারি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আকাশচুম্বি দামে অনেকেই সপ্তাহখানেক ডিম খাওয়া বন্ধ রাখার পক্ষে আন্দোলনে নেমেছেন। অথচ অতি দুঃখের বিষয় ফিডের দাম বস্তা প্রতি ছয় মাসে যে ৮/৯শ টাকা বেড়ে গেল তখন কিন্তু কেউ কথা বলেননি। ডিম আর মুরগির মাংসের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে আর প্রাকৃতিক মহামারিতে যে লাখ লাখ খামারি পথে বসেছে সে খবর কেউ রাখেননি।

রাসেল শিমুল নামের ক্ষুদ্র এক খামারি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিম বিষয়ক আন্দোলনের। তিনি পোল্ট্রি ফিড আর ভ্যাকসিনের দাম সম্পর্কে ধারণা নেয়ার অনুরোধ করে বলেছেন, গত দুদিন ধরে নেতিবাচক প্রচারণার ফলে খামার পর্যায়ে ডিমের দাম দুই টাকা কমে ৯ টাকা হয়েছে। অথচ দোকানে কিনতে গেলে ঠিকই ১২-১৩ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। রাসেল শিমুল বলেন, যদি নেতিবাচক প্রচারণাই চালাতে হয়, তাহলে সেটা ডিমের বাজারের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে চালানো উচিত। যাদের কারণে ৯ টাকার ডিম ভোক্তা পর্যায়ে ১৩ টাকা বা তার বেশি দামে কিনতে হয়। সোচ্চার হতে হবে সেইসব ফিড কোম্পানির বিরুদ্ধে, যারা ২২০০ টাকার ফিডের বস্তা এক বছরে ৩১০০ টাকায় নিয়ে গেছেন।

আরও পড়ুনঃ  পদ্মাসেতুতে বসল ৪০তম স্প্যান

ক্ষুদ্র খামারিদের ভাষ্য, চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে ডিমের বাজার নির্ধারিত হয়। এখানে খামারিদের কোনো হাতই থাকে না। সে কারণে ডিমের নেতিবাচক প্রচারণা থেকে সরে এসে গরীবের গোশত হিসেবে পরিচিত পুষ্টিকর ডিম নিয়মিত পাতে রাখার চেষ্টা করতে হবে। খামারিদের বাঁচিয়ে রাখলেই আমরা পুষ্টি পাব, দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবো।

উৎপাদন আর বিক্রির ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে ডিমের দাম সমন্বয় করার দাবি তুলেছেন খামারি মুক্তার হোসেন। তিনি বলেন, দেখুন প্রায় ব্যবসাতেই ব্যবসায়ীরা নিজের পণ্যের দাম নির্ধারণ করে থাকে। শুধু কৃষি ও কৃষিজাতপণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা তাদের নেই। এখানে পাইকাররা যেমন খুশি তেমনভাবে দাম বাড়ায় কমায়। এখানে সরকারের হাত দেয়া দরকার।

আবুল কালাম নামে আরেক খামারি জানান, গত দেড় বছরে পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতিবস্তা ১৯০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০০ টাকায়। তিনিও এক হাজার মুরগি পালনের একটি হিসেব দিয়ে বললেন, এক হাজার মুরগি পালনের জন্য ঘর তৈরিতে তার ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো। খাঁচা তৈরিতে তার খরচ প্রায় এক লাখ সত্তর হাজার টাকা। ডিম পাড়া পর্যন্ত খামারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬ লাখ টাকার মতো। মুরগির শেডে প্রচুর অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হওয়ার কারণে শেড বেশিদিন টেকসই হয় না। যে কারণে বহুবিধ ব্যয়ের পাল্লা বেড়ে যায়।

আবুল কালামের মতে, পোল্টি শেডের স্থায়িত্বকাল ১০ বছর ধরা হলে দিনে অবচয় ১৩৭ টাকা করে। আর খাচার আয়ুষ্কাল ৫ বছর ধরা হলে দিনে অবচয় হয় ৯৩ টাকা করে। এভাবে ডিম উৎপাদনের আগ পর্যন্ত মোট ব্যয়ের সঙ্গে অবচয় সমন্বয় করতে হয়। এক হাজার মুরগির পেছনে ডিম আসার পরে প্রতিদিনের খরচ তার ৭ হাজার ২৯৩ টাকার মতো। সব মিলে তার দৈনিক ব্যয় দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৫৬ টাকায়।

আরও পড়ুনঃ  অবস্থা বুঝে অফিসের সময়: জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী

আবুল কালামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি লেয়ার ফার্মে সাধারণত প্রথম ডিম আসে ১৩০-১৪৫ দিনের মধ্যে। প্রথম ডিম আসা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ উৎপাদন সীমায় পৌঁছাতে সময় লাগে এক মাস। সর্বোচ্চ উৎপাদন ৯৫ ভাগ হলে তা থাকে সর্বোচ্চ তিন মাস। এরপর প্রতিমাসেই ধারাবাহিকভাবে ডিমের উৎপাদন হার কমতে থাকে।

হিসাব মতে, একটি মুরগি তার জীবন চক্রে গড়ে ৮০ ভাগ ডিম উৎপাদন করে থাকে। অর্থাৎ এক হাজার মুরগি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ ডিম পাওয়া যায়। বর্তমান বাজারদর হিসেবে একজন খামারি ডিম বিক্রি করে দিনে পান ৮ হাজার ৮০০ টাকা। এতে ঐ খামারের আয় আর থাকে না। বরং প্রতিদিন ৫৬ টাকা করে লোকসান গুনতে হয়।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ডিমের দাম সামান্য বেড়ে যাওয়ায় নানা ধরনের কথা হচ্ছে। অথচ উৎপাদন ব্যয় নিয়ে কেউ কথা বলছে না। একটি বাচ্চার দামই ৬২ টাকা। সেই বাচ্চা থেকে ডিম উৎপাদন করতে প্রচুর ব্যয় করতে হয়। বলতে গেলে খামারিরা লাভ পায় না।

খামারিদের সরকারি সহায়তার বিষয়ে হারুন-অর-রশিদ বলেন, তারা মূলত টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। কেউ প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকলে ঋণগ্রহণে সুপারিশ করতে পারেন। তবে নিজেদের ঋণ দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রশিক্ষণের কারণে কিছু সমিতি উপকার পেলেও বেশিরভাগই বঞ্চিত হয়- এমন অভিযোগের ব্যাপারে হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমার উপজেলায় ৬০ হাজার খামারি পরিবার রয়েছে। এগুলো ১২টি সমিতির অধীনে। কিছু মানুষ আমাদের আওতার বাইরে থাকে। ড. হারুন উপজেলা পর্যায়ে আরও লোকবল নিয়োগ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এখানে মাত্র ৪ জন লোক দিয়ে পুরো উপজেলা চালাতে হয়। আরো বেশি ডাক্তার প্রয়োজন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব ড. মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী বলেন, পোল্ট্রিশিল্পের উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে। তাতে করে ডিমের দামও বেড়েছে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে উৎপাদনে উৎসাহ ও নানান ধরনের সহযোগিতা করা। উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণে আমাদের কোন এখতিয়ার নেই।

সচিব বলেন, আমরা এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের নিয়ে মিটিং করেছি। তাতে করে দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে খামারিরা যাতে সঠিক দাম পায় সেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ উৎপাদন ব্যয়ই যদি না আসে তবে এ খাত ছেড়ে দেবে খামারিরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন