একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক প্রতিবেদনটি। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে এক সন্ধ্যায় ৫ বন্ধুর আড্ডা বেশ জমেছে। গল্পের পর গল্পে ঘড়ির কাঁটায় রাত ভারী হচ্ছে। এমন জমাট গল্পের আসরে এক বন্ধু হঠাৎ করে হেসে উঠলো। পাশের বন্ধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসতে শুরু করলো। দু’জনের উল্টে পড়া হাসি দেখে তৃতীয় জনও হাসতে শুরু করলো। এভাবে চতুর্থ ও পঞ্চমজনও হাসতে শুরু করলো।
সবাই সবার দিকে দেখছে আর হাসছে। হেসে কুটিকুটি ভাব। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ পঞ্চম জনের মনে চিন্তা আসে। হাসছি কেন? চতুর্থ জনকে জিজ্ঞাসা করে, হাসছি কেন? উত্তর মেলে না। এখানে পঞ্চমজন একে একে প্রথমজনকে জিজ্ঞাসা করলো। কোনো উত্তর নেই। কোনো কারণে নেই তবু হেসে কুটিকুটি।
চালের বাজারের অস্থিরতা ওই বন্ধুদের মতো। চালের মজুদ অনেক আছে। প্রাকৃতিক কারণে ধান উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও তা এতোটা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট কারণ নয়। অথচ চালের বাজার চড়ে যাচ্ছে। নতুন ধানের প্রভাব নেই চালের বাজারে। কৃত্রিম কারণ সৃষ্টিতেই বাড়ছে চালের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত। একে অপরের ঘাড়ে দোষ দিয়ে যেন নিজেদের খালাস পাওয়া চেষ্টা ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বাজারে সরবরাহ ঘাটতির কথা বলছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে চরম অস্বস্তিতে চরম অসস্তিতে সাধারণ ক্রেতারা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২৯ মে-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে চাল মজুত আছে ১১ দশমিক শূন্য ৩ লাখ টন। এতো বিপুল পরিমাণ চাল মজুদ থাকার পরেও দেশে হু হু করে বেড়েই চলেছে চালের দাম। ভরা মৌসুমে অস্থির চালের বাজার। মোকাম থেকে শুরু করে খুচরা বাজার সবখানেই বিরাজ করছে অস্থিরতা। সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের ধান ও চালের বড় মোকাম নওগাঁয় আবারও বেড়েছে চালের দাম। প্রকারভেদে পাইকারি বাজারে বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৬ থেকে ৮ টাকা। খুচরা বাজারে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা। বাজারে সরবরাহের ঘাটতি কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।
মিল মালিকরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ৮ মণ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন কমে গেছে। ফলে ধানের বাজারে কিছুটা সরবরাহ কম এবং বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মজুদ করার উদ্দেশ্যে বাজারে ধান কিনছে। যার ফলে স্থানীয় ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের মিলাররা প্রতিযোগিতার বাজারে ধান কিনতে পারছেন না। চালও উৎপাদন করতে পারছেনা। যার কারণে চাল উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সপ্তাহ আগে বাড়া শুরু হয় চালের দাম। কিছুদিন আগেও মোকামগুলো থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায় ৫০ কেজির বাস্তা কেনা গেলেও বর্তমানে তা কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫০ টাকায়। ৫০ কেজির বস্তা প্রতি বেড়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত।
খুচরা চাল ব্যবসায়ী উত্তম কুমার বলেন, ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের মিলাররা ধানের বেশি দামের কারণে চাহিদা মতো ধান কিনতে না পারায় চাল উৎপাদন করতে পারছেন না। ফলে বাজারে চাল সরবরাহ কম। নওগাঁর খুচরা বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি কাটারিভোগ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়, জিরাশাইল পুরাতন ৬৫ টাকা, জিরাশাইল নতুন ৬২ টাকা, স্বর্না-৫ এবং মোটা ২৯ জাতের চাল ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়।
এ ব্যাপারে একাধিক ভোক্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ধান ও চাল কিনে রেখে ভবিষ্যতে ভালো মুনাফা করার সুযোগ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা। ধানের উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় মৌসুম শেষে বাজারে ধান না পাওয়ার আশঙ্কায় অনেক ব্যবসায়ী ও চালকলের মালিক ধান কিনে রাখতে বিনিয়োগ করছেন, যা সরবরাহে টান তৈরি করে বাজারে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নওগাঁর খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা আলী আকবর বলেন, ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুদ করার একটি চক্রান্ত করছে। ঊর্ধগতির এই বাজারে এমনিতেই সকলের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। এরপর নতুন করে শুনতে হলো চালের দাম বৃদ্ধি। ভড়া মৌসুমেও যদি এভাবে চালের দাম বাড়ে তবে আমারা সাধারণ ক্রেতারা কেমনে চলব?
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিঘা প্রতি ৬ থেকে ৮ মণ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কম। উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধান কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এরপর আবার বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি সরাসরি কৃষক পর্যায়ে বেশি দামে ধান ক্রয় করে মজুদ করছে।
ফরহাদ হোসেন বলেন, বড় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ও মাঝারি মিলাররা। ফলে বাজারের চাহিদা মতো চাল সরবরাহ করতে পারছি না। সরকারের উচিত এখনি এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেয়া। না হলে সামনে আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে চালের বাজার।
এদিকে, গত রবিবার সচিবালয়ে নিজ অফিসকক্ষে ‘বোরো ২০২২ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং–সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায়’ ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও বলেছেন, বিভিন্ন করপোরেট হাউস ধান–চালের ব্যবসা শুরু করেছে। তারা বাজার থেকে ধান কিনে মজুত করছেন এবং প্যাকেটজাত করছেন। প্যাকেটজাত চাল বেশি দামে বাজারে বিক্রিও হচ্ছে।
মন্ত্রী ধান–চালের ব্যবসায় সম্পৃক্ত করপোরেট হাউসগুলোর সঙ্গে দ্রুততম সময়ে বৈঠক করতে খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধান কিনে মজুত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সবাই প্রতিযোগিতা করে ধান কিনছেন, ভাবছেন ধান কিনলেই লাভ। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভালো পরিণতি আনবে না বলেও সতর্ক করেছেন মন্ত্রী।
আনন্দবাজার/শহক