শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লালমরিচের বাণিজ্যে যুমনার চর

লালমরিচের বাণিজ্যে যুমনার চর

উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার শিল্পের শহর বগুড়া এখন উন্নতমানের লালমরিচের জন্য বিখ্যাত। যমুনার চরাঞ্চলের পলিমাটিতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ লাল মরিচের ফলন হচ্ছে। সেরামানের সেসব লালমরিচ থেকে দেশীয় কয়েকটি কোম্পনি মরিচের গুঁড়া তৈরি ও বাজারজাত করে আসছে। সারাদেশের চাহিদা মেটাচ্ছে সেসব গুঁড়া মরিচ। এতে বদলে গেছে যমুনার চরাঞ্চলের অর্থনীতি। ভাগ্য বদলে ফেলছেন চরের মরিচ চাষিরা। আর এই মরিচের উৎপাদন আর বাজারজাতকরণে জড়িয়ে পড়েছেন এলাকার বহু ব্যবসায়ী।

যমুনার তীরবর্তী সারিয়াকান্দি উপজেলায় গড়ে উঠেছে শত শত মরিচের আড়ত। কর্মসংস্থান হয়েছে অসংখ্য নারী পুরুষের। বাজার আর পরিবহন ব্যবস্থার কারণে দাম পাওয়া নিয়ে যে হতাশা ছিল তা ইতোমধ্যে কেটে গেছে। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় তদারকি থাকলে বগুড়ার মরিচ দেশের চাহিদার অর্ধেক পূরণ করতে সক্ষম বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে যুমনা পাড়ের উপজেলা সারিয়াকান্দির বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ছাড়াও জেলার সোনাতলা, গাবতলী, ধুনট, শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর ও নন্দীগ্রামের প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমিতে লাল মরিচের আবাদ হয়েছে। এসব জমি থেকে উৎপাদন হয়েছে অন্তত ৩৬ হাজার মেট্রিক টন মরিচ। যার বাজারমূল্য প্রায় তিনশ কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি শাজাহানপুর এবং গাবতলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত সেরামানের কাঁচামরিচ মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের দেশগুলিতে রপ্তানি হচ্ছে। চলতি বছরে এখাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা মতো। আবহাওয়া দারুণ অনুকূলে থাকায় কাঙ্ক্ষিত ফলনের পাশাপাশ দাম পাওয়ায় মরিচ চাষিদের এবার চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গাড়ি বানাবে বাংলাদেশ’

বগুড়া জেলা শহরের পূর্বদিকের উপজেলা সারিয়াকান্দিতে বহমান যমুনার বুক চিরে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে মরিচ মৌসুমে লালে লাল হয়ে যায়। এসব চরাঞ্চলের অনেক জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন মরিচচাষিরা। এমনি একজন মরিচচাষি গাবতলী উপজেলার হারুণ অর রশীদ। সারিয়াকান্দির বাটির চরের বিস্তৃর্ণ এলাকায় তিনি অষ্টমবারের মতো মরিচ চাষ করেছেন। ক্ষেত থেকে ইতোমধ্যে মরিচ সংগ্রহ করছেন। বিঘাপ্রতি লাগানো হাইব্রিড জাতের গ্রিন সুপার মরিচের ফলন হয়েছে দুইশ মণ পর্যন্ত। গত আশ্বিন-কার্তিক মাসে জমি থেকে প্রতিমণ মরিচ তিনি সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। দাম কিছুটা উঠানামা করলেও তার লাভ হয়েছে বেশ। সার-বীজ, কীটনাশকসহ বিঘাপ্রতি মরিচ আবাদে তার খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকার মতো। তারপরও তিনি বিঘাপ্রতি আয় করেছেন দেড় লাখ টাকার মতো। হারুণ অর রশীদের মতোই অসংখ্য মরিচচাষির মুখে এবার দারুণ হাসি ফুটেছে।

মরিচ চাষিদের দেয়া তথ্যমতে, দেশি জাতের মরিচ চাষে এবার প্রতি বিঘায় সব মিলে খরচ হয়েছে ১৮ হাজার টাকার মতো। চাষিরা এবার বিঘা প্রতি সর্ব্বোচ্চ মরিচ সংগ্রহ করেছেন ৪০ মণ পর্যন্ত। এসব দেশি মরিচ বিক্রি হয়েছে সাতশ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। খরচ বাদ দিয়েও বিঘাপ্রতি মরিচচাষে চাষিদের লাভ হয়েছে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকার মতো। ক্ষেত থেকে কাঁচা মরিচ তোলার পর জমিতে যে মরিচগুলো লাল হয়ে পেকে যায় সেসব মরিচই শুকানো হয়। সাধারণত শুকনা মরিচ গুঁড়া করেই বাজারজাত করা হয়। কৃষকরা পাকা মরিচের চেয়ে শুকনো মরিচ বিক্রি করেন কেজি প্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে।

আরও পড়ুনঃ  ইইউ’র তহবিলে উপকৃত হবে ছয় দেশ

চলতি মৌসুমে পাকা মরিচ বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। বেশি দামের আশায় এসব মরিচ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চাষিরাও সংগ্রহ করে রোদে শুকান। শুকানোর পর এক বিঘা জমির মরিচের ওজন হয় ৮ থেকে ৯ মণ। বাজারে প্রতিমণ শুকনো মরিচের দাম ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৬৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। বগুড়ায় সবচেয়ে বেশি মরিচের চাষ হয় সারিয়াকান্দির বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, উৎপাদিত মরিচের মধ্যে ৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে শুকনা মরিচের চাষ হয়। আর ১ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে আবাদ হওয়া মরিচ কাঁচা অবস্থাতেই বিক্রি হয়।

যমুনার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে প্রতিবছর মরিচের বাম্পার ফলন আর সেই মরিচ ঘিরে অর্থনীতির যে বদল ঘটছে তাতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন সারিয়াকান্দির বহু ব্যবসায়ী। বিশেষ করে গেল প্রায় দেড় দশক ধরে প্রাণ ও স্কয়ারের মতো দেশীয় বড় কোম্পানিগুলো যখন চরাঞ্চলের সেরামানের লালমরিচ কেনা শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরেই এসব কোম্পানি চরের সেরামানের মরিচ সংগ্রহের পর স্থানীয়ভাবে গুঁড়া তৈরি করছে। পরে সেগুলো প্যাকেটজাত করে সারাদেশে বাজারজাতকরণ করছে। এতে চরের মরিচের চাহিদা ও উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে বগুড়ায় মরিচের বাজার বড় হতে শুরু করে। মরিচ চাষ, সংগ্রহ, সরবরাহ আর প্রক্রিয়াকরণ বাড়তে থাকে কর্মসংস্থান। বিশেষ করে মরিচের আড়তে সবচেয়ে বেশি কাজ খুঁজে পেয়েছেন নারী শ্রমিকরা।

চরের সম্ভাবনাময় মরিচ ঘিরে ব্যবসা শুরু করা সারিয়াকান্দির শাহ মোহাম্মদ করিম দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, তিনি স্কয়ার ও প্রাণ কোম্পানিকে স্থানীয়ভাবে শুকনো মরিচ সরবরাহ করছেন। তবে তার প্রধান সমস্যা এখন মোটরশ্রমিক আর তাদের সিন্ডিকেট। তাদের জন্য প্রতি ট্রিপ মরিচ পরিবহনে দুইশ থেকে তিনশ টাকা চাঁদা দিতে হয়। শ্রমিক খরচ যেমন বেশি হয়েছে, তেমনি ব্যাংকের চড়া সুদের কারণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তার ওপর আবার কিছু স্থানীয় কোম্পানি মরিচ কিনে বছরের পর বছর টাকা বকেয়া রেখে দিচ্ছে। এতে বেশি লাভেও কিছু হচ্ছে না। অবশ্য আরো বেশি কোম্পানি যদি মরিচে বিনিয়োগ করতো তাহলে, এলাকায় কারাখানা স্থাপন করতো, তাহলে ব্যবসায়ীরা আরো উপকৃত হতো।

আরও পড়ুনঃ  টায়ারে নতুন দিগন্ত

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মরিচ বেচাকেনা নিয়ে এখনো কিছু সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। যে কারণে চাষিরা আশানুরূপ দাম পাচ্ছেন না। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থা যদি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সরাসরি তদারকি করতো তাহলে সংকট কেটে গিয়ে সারাদেশের চাহিদা মিটতো বগুড়ার সেরা ও উন্নতমানের লালমরিচে।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দুলাল হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, জেলায় প্রাণ, স্কয়ার, ফ্রেশ কোম্পনি মরিচের গুঁড়া তৈরির মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে। নতুন নতুন আরো কোম্পানি যদি এই মরিচের গুঁড়া তৈরিতে বিনিয়োগ করতো তাহলে মরিচ চাষিদের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর হতো। মরিচের উৎপাদনও দ্বিগুণ তিনগুণ বাড়তো। আগামীতে মরিচের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন