শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রেকর্ড ফলনেও কম রপ্তানি

চা উৎপাদন

গত তিনবছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চা উৎপাদন বেড়ে চলেছে আশাব্যঞ্জকভাবে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য এক চমকপ্রদ খবর। এক বছরের ব্যবধানে দেশে চা উৎপাদন এক কোটি কেজিরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে চা চাষের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দশ বছরে চা চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত ৩০ হাজার একর জমিতে। এর পরিমাণ আরো বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন চা বাগানে নানা কার্যক্রম চলছে।

দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চা রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়েও নানা ধরনের কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। তবে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে চায়ের ব্যবহারের তুলনায় উৎপাদন বাড়লেও কমে গেছে রপ্তানি। অথচ গত তিন বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ চা। তবে যানবাহনের খরচ বেড়ে যাওয়া, বিদেশি মার্কেট না ধরা এবং ব্র্যান্ডিং না করার কারণেই চা রপ্তানির খাত প্রসারিত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

চা বোর্ড সূত্রমতে, গত অর্থবছরেও চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে রেকর্ড গড়া সম্ভব হয়েছে। তবে গত কয়েক বছরে চায়ের ব্যবহার কম দেখা যাচ্ছে। এর জন্য করোনা মহামারীকে দায়ী করছেন তারা। স্বাভাবিক সময়ে সব প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় চায়ের চাহিদাও বাড়ে। কিন্তু করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পুরোদেশ লকডাউন থাকায় এসব ক্ষেত্রগুলো বন্ধ ছিল। তাই চায়ের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে। পাশাপাশি বর্তমানে যে পরিমাণে চা রপ্তানি হয় তা খুবই নগন্য। তাই দেশিয় চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে বিদেশে চায়ের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

চা বোর্ডের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, করোনাকালে দেশে চা উৎপাদন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে এক কোটি কেজিরও বেশি চা উৎপাদন বৃদ্ধি পুরো সেক্টরকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছে। ১৬৭টি বাগান জুড়ে চলছে উৎপাদনের মহাযজ্ঞ। ২০২১ সালে দেশে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার ৬শ’ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় ১ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার কেজি বেশি। ২০২০ সালে দেশে ৮ কোটি ৬ লাখ ৩ হাজার ৪শ’ কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬ হাজার ৯শ’ কেজি। গত বছর করোনার ভয়াল সময়েও দেশে চা উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙেছে।

আরও পড়ুনঃ  মার্কিন নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা

দেশের চা বাগানগুলোতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চা সেক্টরের জন্য সরকারের আর্থিক প্রণোদনা, মন্ত্রণালয় এবং চা বোর্ডের মনিটরিং, পরামর্শ প্রদান, মালিক শ্রমিকদের নিরলস চেষ্টা উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে বাগান সম্প্রসারণ, ক্লোনের মাধ্যমে ভালো জাতের চারা তৈরি এবং রোপণ, রোগ প্রতিরোধী চারা রোপণ, বেশি ফলনের চারা তৈরি করে বাগান সম্প্রসারণ, পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে চা চাষ অতীতের গৌরব ফিরে পেতে শুরু করেছে। এক বছরের ব্যবধানে এক কোটি কেজিরও বেশি চা উৎপাদন বৃদ্ধি এ সব কর্মকাণ্ডেরই সুফল বলে মনে করছেন চাখাতের ব্যবসায়ীরা।

তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৬ হাজার কেজি চা ব্যবহারের বিপরীতে ৭ কোটি ১০ লাখ ৮৩ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। তাছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৭১ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে, ব্যবহার হয়েছে ৮ কোটি ৫০ লাখ ৬৫ হাজার কেজি। অপরদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ কোটি ৯৯ লাখ ৩০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হলেও ৮ কোটি ৫৩ লাখ ৮২ হাজার কেজি চা ব্যবহার হয়েছে। এদিকে, ২০২১ সালে ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৮০ হাজার কেজি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। ২০২০ সালে ৭ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার কেজি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার একই চিত্র ২০১৯ সালেও। ওই বছর চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ কোটি ৪১ লাখ ৪০ হাজার কেজি। উৎপাদন হয়েছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা।

চা বোর্ড সূত্রমতে, বিগত তিন বছরে চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও তেমন প্রসারিত হয়নি রপ্তানি খাত। চট্টগ্রাম ও সিলেটে উৎপাদিত চা অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জাপান, চায়না, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়ে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ লাখ ৬৬ হাজার কেজি খোলা চা ও ৮ লাখ ৭০ হাজার কেজি প্যাকেট চা রপ্তানি করা হয়। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৮ হাজার কেজি খোলা চা ও ৭ লাখ ২৫ হাজার কেজি প্যাকেট চা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫৮ হাজার কেজি খোলা চা এবং ২ লাখ ৫৪ হাজার কেজি প্যাকেট চা। সেই হিসেবে বিদেশে চা রপ্তানির খাত প্রসারিত হয়নি।

আরও পড়ুনঃ  সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত

চা বোর্ডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দেশে গত অর্থবছরে যে পরিমাণে চা উৎপাদন হয়েছে তা লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলতি অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি আমাদের চা উৎপাদন ও ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি। তবে করোনার কারণে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে চায়ের ব্যবহার কিছুটা কমেছে। সেই সঙ্গে চা রপ্তানির হারও অনেক কম। সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করলে চা রপ্তানির পাশাপাশি এ শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

চা বোর্ডের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রচুর। এ জন্য বিদেশে রপ্তানি ক্রমে কমে আসছে। আমাদের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলে অতীতের মতো আবারো চা রপ্তানিতে বাংলাদেশ হারানো ঐতিহ্য উদ্ধার করতে পারবে। বর্তমানে ১৯টি দেশে চা রপ্তানি হয় বলে উল্লেখ করে তিনি জানান, তবে চা রপ্তানির পরিমাণ মোটেই সন্তোষজনক নয়। পরিমাণ আরো অনেক বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের পার্বত্যাঞ্চলে অনেক বেশি চা বাগান গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে অন্তত ১ কোটি কেজি চা রপ্তানির লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

চট্টগ্রাম চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম (এনডিসি পিএসসি) বলেন, ‘চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও আমাদের দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে চায়ের ব্যবহার বাড়ার কথা ছিল সেভাবে বাড়েনি। এটা করোনার কারণেই হয়েছে। কারণ করোনার সময় চট্টগ্রামসহ সারাদেশের চা দোকান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বন্ধ ছিল। এর একটা প্রভাব এখানে পড়েছে। চায়ের উৎপাদন আরো বাড়াতে সমতল ভূমিগুলোতে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট, শ্রীমঙ্গলের পাশাপাশি পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁওয়ে ক্ষুদ্রায়তন পদ্ধতিতে চায়ের চাষাবাদের সুযোগ দিচ্ছি আমরা। এ পদ্ধতিতে আমরা সুফল পাচ্ছি। এ পদ্ধতিতে এবার প্রায় সাড়ে ১৪ মিলিয়ন চা উৎপাদন হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  চট্টগ্রামে করোনায় ৬ বছরের শিশুর মৃত্যু

চট্টগ্রাম চা বোর্ডের চেয়ারম্যান আরও বলেন, চায়ের উৎপাদন বাড়লেও ওইভাবে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তাই আমাদের এবার রপ্তানিমুখী হতে হবে। সে কারণে এ বছর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় রপ্তানিকারকদের ৪ শতাংশ ক্যাশ ইন্সেন্টিভ দেয়া হচ্ছে। দেশিয় চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়েই চায়ের রপ্তানি বাড়ানো হবে।

সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশদের হাত ধরে দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামেই চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮৫৪ সালে সিলেট অঞ্চলে চা চাষ শুরু হয়। দেশে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এরমধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় চা বাগানসহ চট্টগ্রামে বাগান রয়েছে ২২টি। তবে সবচেয়ে বেশি বাগান রয়েছে মৌলভীবাজারে ৯১টি। এ ছাড়া হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙামাটিতে ২টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান রয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের পাশাপাশি সমতল ভূমিতেও চা চাষ নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এরই প্রেক্ষিতে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে চায়ের জমি।

বর্তমানে দেশে ১ লাখ ৬২ হাজার একর ভূমিতে চা চাষ করা হচ্ছে। গত ১০ বছরে চা চাষের আয়তন ৩০ হাজার একরেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে উৎপাদনেও বড় প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আধুনিক নানা প্রযুক্তি, রোগ প্রতিরোধী ওষুধ, উন্নতজাতের চারা উৎপাদন, সার কীটনাশকসহ নানা সুযোগ সুবিধার কারণে চা উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধারা ধরে রাখা সম্ভব হলে চলতি বছর দেশের চা উৎপাদন ১০ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০২৫ সালে ১২ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন