শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তরের আলুতে রপ্তানির হাসি

উত্তরের আলুতে রপ্তানির হাসি

প্রতিবছর জেলায় অনেক বেশি আলু উৎপাদন হয়। বাজারেও আলু অনেক। তারপরও দাম নাগালে আসে না। আসলে আলুর বাজারের চরিত্র মাথায় ঢোকেই না। এমন মন্তব্য রংপুর শহরের একটি বাজারে আলু কিনতে আসা ক্রেতা শহিদুল ইসলামের। তিনি আরো বলেন, প্রকারভেদে ১২ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে আলু কিনতে হচ্ছে। দরটা অনেক বেশি হয়ে যায়। আলুর কেজি ৮ থেকে ১০ টাকার মধ্যে হলে আমাদের জন্য ভালো হতো।

উত্তরের জেলা রংপুরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। জেলায় আলুর আবাদ কম হচ্ছে না। আলুর কোনো সংকটই নেই। তারপরও দাম পড়ছে না। ক্রেতারা বাজারে গিয়ে অনেক সময় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ‍উত্তরের আলুর বাজারগুলোর এমন চরিত্রের পেছনে রয়েছে রপ্তানি। প্রচুর পরিমাণ আলু দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় স্থানীয় ক্রেতাদের বেশি দামে আলু কিনতে হচ্ছে।

মূলত, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলু রপ্তানি হচ্ছে হচ্ছে। এসব দেশের তালিকায় রয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীন ও কাতারের মতো দেশ। উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে আলুর কোনোই সংকট নেই। আলুচাষিরাও লাভবান হচ্ছেন। তবে শুধু কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ক্রেতাদের। তারা বলছেন, ভরা মৌসুমেই চড়া দামে আলু কিনতে হচ্ছে। সামনে রমজান মাসে দাম আরো বড়বে। তাতে দুর্ভোগে পড়তে হবে ক্রেতাদের।

অথচ নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ভাতের সঙ্গে প্রধান তরকারি এই আলু। অনেকেই আবার ভাতের পরিবর্তে আলু খাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রতিবছর ভরা মৌসুমে আলুর দাম কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত থাকে। তবে এবারের চিত্রটা ঠিক উল্টো। ভরা মৌসুমেই আলু কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। এর আগে অসময়ে মাঘের দুই দফা বৃষ্টিতে লোকসান গুনেছেন চাষিরা। তাই উৎপাদন বেশি হলেও আগাম আলুর দাম পাননি তারা। তবে আলুর দাম আগে না পেলেও এখন মুখে হাসি ফুটেছে তাদের। চাষিরা বলছেন, বৃষ্টিতে লোকসান হলেও এখন দাম ভালো পেয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  এশিয়ার সেরা হয়ে সোনা জিতলেন রোমান-নাসরিন

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভূল্লীর আলুচাষি খয়বর ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আগাম আলু উৎপাদনে দুই লাখ টাকা লোকসান হলেও এখন দাম পাচ্ছি ভালো। প্রতি কেজি ১৪ টাকা দরে ক্ষেত থেকেই আলু বিক্রি হচ্ছে। এত বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে যে অন্য বছরের শেষ সময়ে অনেক চড়া দামে কিনলেও এবারে কম দামে কিনতে পারবেন। বিশেষ করে কোল্ডস্টোরেজ জাত আলু প্রতি কেজি ২০ থেকে ২২ টাকায় কিনতে পারবেন ক্রেতারা।

লালমনিরহাট সদরের বড়বাড়ির আলু ব্যবসায়ী মেসার্স নার্গিস ট্রেডার্সের পরিচালক নাছির উদ্দীন এ পর্যন্ত তিন কনটেইনারে ১৩ টন আলু বিদেশে রপ্তানি করেছেন। এছাড়া আরো একশ টন আলু সরবরাহে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। নাছির উদ্দীন বলেন, লালমনিরহাট থেকে আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী রংপুর, যশোরসহ অনেক বড় ব্যবসায়িকে আলু দিচ্ছেন বিদেশে পাঠানোর জন্য। বাজার থেকে ১৪ থেকে ১৫ টাকা দরে আলু কিনে রপ্তানির জন্য ১৭ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের আলু ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর আলু উৎপাদন হয়েছে অনেক বেশি। কোল্ড স্টোরেজে আলুর ৫৫ কেজির প্রতি বস্তার ভাড়া ২৬০ টাকা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। আমরা দাবি জানিয়েছিলাম যেন ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দাবি পূরণ হয়নি। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের দাবিগুলো মানা হয় না। তাই অনেক ব্যবসায়ী বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাভবানও হচ্ছেন। খুচরা বাজারে জাতভেদে প্রতিকেজি আলু ১৮ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  টানা পতনে আতঙ্ক

আলু ক্রেতা জিয়াউল হক রকি বলেন, আগাম আলু বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। এ আলু বাজারে আসার সময় অনেক কম দামে কিনেছিলাম। তবে এখন একটু বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে রংপুর থেকে আলু বিদেশে যাচ্ছে। অনেক ভালো। তবে এত বেশি উৎপাদন হয়েও প্রতি বছর বাজারে আলুর সংকট দেখা দেয়ায় প্রতি কেজি ৫০ টাকা পর্যন্ত কিনতে হয়। এ বছর যেন কোল্ড স্টোরেজ জাতআলুর বাজারে সংকট না তৈরি হয় সে জন্য ব্যবস্থা নেবে সরকার, এই আশা করি।

খুচরা বাজারে আলুর ক্রেতা মহিউদ্দীন আলম বলেন, আলুর বাজার ব্যবস্থাটা মাথায় ঢোকে না। প্রতিবছর এ অঞ্চলে অনেক বেশি আলু উৎপাদন হয়। বাজারে অনেক সরবরাহ আছে, তবুও দামে বেশি। প্রকারভেদে ১২ থেকে ২০ টাকা দরে আলু কিনতে হচ্ছে যা অসহনীয় মনে হচ্ছে।

ক্রেতা সুবি রানী বলেন, ‘আলু আমাদের গরিব মানুষের প্রতিদিনের তরকারি। আমরা শুধু শুনছি রংপুরে অনেক বেশি আলু উৎপাদন হয়। চাহিদার তুলনায় যা অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তবে আলু বেশি দামে কিনে খেতে হয় আমাদের। দু-এক দিন দাম কমলেও পরে আবার বেড়ে যায়।

রংপুর বিভাগীয় মার্কেটিং কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্র জানায়, প্রতি বছরই এই অঞ্চল থেকে আলু বিদেশে যায়। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। এবছর এখন পর্যন্ত চার হাজার টন আলু বিদেশে পাঠিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চাষিরাও ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন। বিভাগীয় মার্কেটিং কর্মকর্তা শাহিনুর ইসলাম জানান, আলু বিদেশে যাওয়ায় এখনই কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। আমরা মনিটারিং করছি যাতে ক্রেতারা সংকটে না পড়েন।

আরও পড়ুনঃ  বিজেএমসির কাছে চাষী ও পাট ব্যবসায়ীদের ২৬৫ কোটি টাকা পাওনা

রংপুর কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মাহবুবার রহমান জানান, এ বছর লক্ষ্যমাত্রার বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে এই বিভাগে। বিভাগের ৮ জেলায় এক লাখ ৩৬ হাজার ৭৭ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৮ মেট্রিক টন। এখন পর্যন্ত আলু তোলা হয়েছে ৪৫ লাখ ২৫ হাজার ৪৮২ মেট্রিক টন।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন