শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তরের চরাঞ্চলে কৃষিবিপ্লব

পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের বৃহৎ নদীগুলো এখন শুকনো মরা খালে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের প্রবল খরস্রোতা এসব নদীর বুকে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ বালুচর। মরুভূমির মতো ধু-ধু এসব চরের বুকেই নীরব কৃষিবিপ্লব ঘটিয়েছেন ভূমিহীন বর্গাচাষিরা। চরভিত্তিক এই কৃষিবিপ্লবে ভাগ্য ফিরছে অবহেলিত উত্তরাঞ্চলের লক্ষাধিক ভূমিহীন পরিবারের।

পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের বৃহৎ নদীগুলো এখন শুকনো মরা খালে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের প্রবল খরস্রোতা এসব নদীর বুকে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ বালুচর। মরুভূমির মতো ধু-ধু এসব চরের বুকেই নীরব কৃষিবিপ্লব ঘটিয়েছেন ভূমিহীন বর্গাচাষিরা। চরভিত্তিক এই কৃষিবিপ্লবে ভাগ্য ফিরছে অবহেলিত উত্তরাঞ্চলের লক্ষাধিক ভূমিহীন পরিবারের।

পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী উত্তরজনপদের প্রায় ৮শ’ চরের বুকে এখন সবুজের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। ধু-ধু বালুচরে সবুজ ফসল ফলিয়ে জীবিকার সন্ধান পেয়েছেন চরাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষেরাও। অন্যান্য ফসল ফলানো খুব কঠিন হলেও ব্যাপকহারে আলু, বাদাম ও মিষ্টিকুমড়া চাষে কৃষিতে ঘটে গেছে নীবর বিপ্লব।

রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলার পদ্মা, যমুনা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর বুকে জেগে ওঠা কমপক্ষে তিনশ চরে চলতি মৌসুমে প্রায় এক লাখ একর জমিতে দেড় লাখ টন বাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এ মৌসুমে বাদামের বাম্পার ফলনের আশাও করছেন চাষিরা। ইতোমধ্যে চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করে ৫০ হাজার ভূমিহীন বর্গাচাষি ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। আরও প্রায় ৫০ হাজার হতদরিদ্র পরিবার বাদাম চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন জীবন-জীবিকা।

পাবনা ও সিরাজগঞ্জের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শুধু যমুনা ও পদ্মা নদীর চরাঞ্চলেই সদ্যবিদায়ী বছরে বাদাম চাষ করেছিলেন প্রায় ৩০ হাজার চাষি। এর আগে যমুনা-পদ্মার ভাঙনে সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করে আসছিল। নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত এসব মানুষের চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়েছে বাদাম চাষ।

সিরাজগঞ্জ ও পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রমতে, গেল বছর চরাঞ্চলের ২৭ হাজার একর পলিযুক্ত বেলে- দোআঁশ মাটিতে সাড়ে ৪৬ হাজার টন বাদাম উৎপাদন হয়। এতে সিরাজগঞ্জ ও পাবনার জেলার প্রায় ২৫ হাজার ভূমিহীন বর্গাচাষির পরিবারে ফিরে আসে সচ্ছলতা। চরাঞ্চলে বাদামের বাম্পার ফলনের পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা লাভের মুখ দেখছেন গত কয়েক বছর ধরে। এবারো বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা। সেইসঙ্গে এসব চরে বাদামের পাশাপাশি মিষ্টি কুমড়া চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় জীবন-জীবিকায় আসছে ইতিবাচক পরিবর্তন। চরাঞ্চলে একদিকে কর্মহীন হতদরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান করছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া চরাঞ্চলে উন্নয়নের নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  করোনার প্রভাব পড়েছে পেঁয়াজ-রসুন-আদার বাজারে

সূত্রমতে, যমুনা ও পদ্মার বুকে জেগে ওঠা ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত দেড় শতাধিক চরে মৌসুমী ফসল হিসেবে বাদামের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। এসব চরের মধ্যে রয়েছে, নাটুয়ারপাড়া, ঘোড়াগাছা, রেহাইশুড়িবেড়, পানাগাড়ী, চরপানাগাড়ী, তেকানী, খাসরাজবাড়ী, যুক্তিগাছা, মাজনাবাড়ী, শালগ্রাম, শালদহ, চরছিন্না, চরগিরিশ, রঘুনাথপুর, নিশ্চিন্তপুর, শুভগাছা, মাইজবাড়ী, পীরগাছা, সানন্ধা, চরপেচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, চরসাফুলা, চরনাগদা, চরঢালা, চরকল্যাণপুর, পূর্ব শ্রীকণ্ঠদিয়া, পদ্মারচর, বাইরচর, শ্রীপুর, খিদ্রদাশুরিয়া, মুরাদপুর, বরাংগাল, ঘোড়জান, কোমরপুর, বীরপুর, পীরপুর ও চালাকপাড়া। এসব চর ঘিরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, লালমনিরহাট, রংপুর ও কুড়িগ্রামে তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল জুড়ে এখন সবুজের সমারোহ। বাম্পার ফসলের হাতছানিতে চাষিদের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। তিস্তার ফসলে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনছেন সব হারানো চাষিরা। ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন তারা। শীতকালীন নানা সবজিতে ভরে উঠেছে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। চরের বেলে দোআঁশ মাটিতে চাষিরা যেন সোনার ফসল ফলিয়ে চলছেন। সবজির প্রাচুর্য দেখে শুধু সাধারণ মানুষেরই নয়, চোখ জুড়াচ্ছে চাষিদেরও। তবে শুধু দামে মন ভরছে না তাদের। একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা গতিশীল না হওয়ার কারণেই চাষিদের লাভ হচ্ছে কম।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, তিস্তার চরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলের জমি ৫৬ হাজার ৯৪ হেক্টর। এরমধ্যে আবাদযোগ্য চরের ভূমি ৪৭ হাজার ৭৪৮ হেক্টর। এবার এসব চরের ৩৬৬৫ হেক্টরে সবজি চাষ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে আলু। আগাম আলু চাষ করে লাভবান হয়েছেন চাষিরা। চরের বিশাল বুক জুড়ে এখন টমেটো, বাঁধাকপি, বেগুন, শিম, লাউ, পেঁপেসহ বিভিন্ন তরতাজা সবজি। পিঁয়াজ, রসুন, মাসকলাইসহ আরও নানা মৌসুমী ফসল ফলাচ্ছেন চাষিরা। তারা বলছেন, বেলে দোআঁশ মাটিতে সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। পোকামাকড়েরও আক্রমণ কম। তাই খুব একটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। শুধু পানি পেলেই চরে সব ফসলের আবাদ ভালো হয়। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সবজির দাম পাচ্ছেন কম। তবে এখন চরে বিদ্যুৎ আসার কারণে সেচের যোগানও হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  আজও ৬ বিভাগে বৃষ্টি হতে পারে

লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলাধীন রুদ্রেশ্বর চর রুদ্রেশ্বরের চাষি আমির হোসেন বলেন, নদী বড় থাকলে নৌকায় তাদের যোগাযোগ সহজ হয়। তবে তখন পানি ঢুকে চাষের জমি কমে যায়। আবার পানি নেমে গেলে যে পলি পড়ে তাতে সবজির চাষ ভালো হয়। তখন আবার নৌ চলাচলের পথ কমে গিয়ে বেড়ে যায় পায়ে হাঁটার পথ। এই দুর্গমচর থেকে তাদের সবজি ওপারের বাজারে নিতে নিতেই তাজা সবজি আর তাজা থাকে না। তখন পাইকারি ক্রেতারা দাম কম দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী চরে সবজি কিনতে আসেন। তবে বিশাল চর আর নদী পাড়ি দিয়ে সবজি নিয়ে যেতে হবে বলে তাদের কম দাম দেয়া হয়। এতে তাদের ক্ষতি না হলেও লাভের পরিমাণ কমে যায়।

একই এলাকার টমেটো চাষি নুর আলী বলেন, নদীর ওপারে যদি টমেটোর কেজি ১০০ টাকা হয়, তাহলে এপারে ৫০ টাকা। একটা নদীর এপার-ওপারে দামের এমন পার্থক্য। চাষি মানিক বলেন, গ্রীষ্মকালে পানি কমে নদী ছোট হয়ে আসে। তখন সবজি গরু-মহিষের গাড়ি অথবা ট্রলিতে করে নিয়ে চর পাড়ি দিতে হয়। তবে চরের মাঝে যদি আবার ছোট নদী থাকে তাহলে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। এসব ভোগান্তির কারণেই ভালো সবজি উৎপাদন করলেও ভালো দাম পান না। কুটিরপাড় গ্রামের আসাদুল জানান, তিনি ৫ বিঘা জমিতে শীতকালীন শাকসবজি হিসেবে কপি ও বেগুন চাষ করছেন। সেচের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মোটর।

সদরের রাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন বলেন, চরের সবজি খুব সুস্বাদু। নদীর ওপারের সবজি আর এপারের সবজির স্বাদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। চরাঞ্চলের সবজির স্বাদ ভালো হওয়ার কারণ এখানে জমিতে সার-কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। শুধু পানি পেলেই চরে খুব ভালো সবজি উৎপাদন হয়। তবে এত ভালো সবজি উৎপাদন করেও চাষিরা ভালো মূল্য পান না।

আরও পড়ুনঃ  সংকট-শঙ্কা নিয়েই শুরু

চাষিরা বলছেন, নদীপাড় থেকে চরের গ্রাম পর্যন্ত যদি পাকা রাস্তা নির্মাণ করা যায় তাহলে চাষিদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। চাষিরা অন্তত সহজে নদীপাড় পর্যন্ত তাদের ফসল নির্বিঘ্নে নিয়ে যেতে পারবেন। এদিকে তিস্তা নদীতে চর জেগে ওঠা এসব জমিতে এখন সারাবছর ধরে উৎপাদন করা হচ্ছে বিভিন্ন সবজি। যা স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজারজাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ অঞ্চলের লোকজন জানান, এক সময় চরাঞ্চলের জমিতে শুধু ধান, গম আর ভুট্টা চাষ হতো। কিন্তু এখন সেই জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে পেয়ারা বাগান, কলা বাগানসহ বিভিন্ন রকম সবজি। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এখন ভরেছে আগাম সবজিতে। কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদ করে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করছেন।

চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, আদিতমারী উপজেলার নদী তীরবর্তী মহিষখোচা ইউনিয়নের বালাপাড়া, কুটিরপাড়, কালমাটি, আনন্দবাজার, কালিগঞ্জের রুদ্রেশ্বর, কাকিনা, মহিষামুরি, ইশোরকুল চরাঞ্চলে এবার আলু, বেগুন, টমেটো, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, করলা, পুঁইশাক ও লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি হয়েছে। পাশাপাশি পিঁয়াজ ও রসুনের আবাদও হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, খুব শিগগিরই নতুন পেঁয়াজ ও রসুন উঠবে। পাশাপাশি চাষ হচ্ছে গম, ছোলা, ভুট্টা, মসুর, সরিষা ও বাদামের।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক তৌহিদুল ইকবাল বলেন, চরের মাটিতে যেকোনো ফসলের আবাদ অত্যন্ত ভালো হয়ে থাকে। প্রতিবছর বন্যায় জমি তলিয়ে যাওয়ার পর নতুন করে পলি জমার কারণে চাষাবাদ ভালো হয়। এ বছর দাম কিছুটা ভালো পাওয়া যাচ্ছে। চাষিরাও লাভবান হচ্ছে। চরের চাষিদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন