এস,এম, নুরুন্নবী
‘মাদক মামলার সাজা মুক্তিযুদ্ধের বই পড়া’ ( বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ০৯ মার্চ, ২০২০), কিংবা ‘হামলার মামলায় আসামিকে এক বছর বই পড়া ও সিনেমা দেখার সাজা’,( যুগান্তর ডট কম, ০৩ মার্চ ২০২০), এমন ব্যতিক্রমী সাজা গুলো হলো প্রবেশন আইনে দেয়া। দেশের প্রথাগত বিচার ও শাস্তির পাশাপাশি অপরাধীকে সংশোধন এবং পুনর্বাসনে এই পদক্ষেপ গুলো বিশ্বের নানা দেশের আইনে রয়েছে। যেমন মার্কিন অভিনেত্রী লিন্ডসে লোহান ‘শপ লিফটিং’ এর অভিযোগে আদালত তাকে ‘শপ লিফটিং থেরাপি’ দিয়েছিলো সাজা হিসেবে। এই ধরণের সাজাকে বলা হয় ’প্রবেশন’। বাংলাদেশেও এমন একটি পুরোনো আইনি সুযোগ আছে। আমার আজকের লেখার প্রসঙ্গ সেই আইনটি।
‘দ্য প্রবেশন অফ অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০’ নামক আইনটি কার্যকর করতে একটি আদেশ জারি করেছিলো মহামান্য হাইকোর্ট, যার স্মারক নং- জে-০১/২০১৯, প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে। উক্ত আদেশের পর দেশের কয়েকটি অধস্তন আদালত উল্লেখিত আইনের অধীনে বেশ কয়েকটি আদেশ দিয়েছে। এবং তা দেশের নাগরিক সমাজে সমাদৃত হয়েছে। সেই আইনের কয়েকটি দিক আমি দেশের নাগরিক সমাজ ও সরকারের সামনে তুলে ধরতে চাই।
প্রথমত, পাঠদের জানিয়ে রাখতে চাই, এটি পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইসকান্দার মির্জার জারি করা একটি অধ্যাদেশ। সামরিক কায়দায় করা অন্য আর দশটা সামরিক ফরমানের মত এই আইনটিও অস্পষ্ট ও সাংঘর্ষিক নানা ক্ষেত্রে। উপরন্তু কালের বিবর্তনে অধ্যাদেশটি হয়ে গেছে পুরোনো ও অচল। তাছাড়া গণতান্ত্রিক দেশে অধ্যাদেশ করা হয় সংসদের অনুপস্থিতিতে, জরুরি প্রয়োজনে। ‘প্রবেশন’ এর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আইনে পরিণত না করে অধ্যাদেশ হিসেবে ফেলে রাখা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু।
দ্বিতীয়ত, অধ্যাদেশটির বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত রূপ নেই। যা একাধারে ‘বাংলাভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭’ এর ৩(১) ধারার বরখেলাপ। এছাড়া ১৯৮৯ সালে ৩ ডিসেম্বর তারিখের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশ, যার স্মারক নং- সম (বা বা কে)-২৬/৮৯-৩৩৬ (২০০) এর ২(ক) সিদ্ধান্তেরও বিরুদ্ধে। এই আদেশে বলা হয়, ‘যে সকল আইন হালনাগাদ কিংবা পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন, সেগুলো হালনাগাদ করে বঙ্গানুবাদ করতে হবে।‘ আলোচ্য আইনটি হালনাগাদও করা হয়নি, বঙ্গানুবাদও করা হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে প্রতিটি আইনের বাংলা ও ইংরেজি রূপ দেয়া আছে, তবে এই আইনটির শুধু ইংরেজি রূপই দেয়া, বাংলা নেই। ফলে আদালতে দাখিল বা জেরা বা শুনানির ক্ষেত্রে আবশ্যিক ভাবে ইংরেজি ব্যবহার করতে হবে।
তৃতীয়ত, অধ্যাদেশটির ৩য় অধ্যায়ে ‘কোর্টস এমপাওয়ারড আন্ডার দ্য অর্ডিন্যান্স’ অংশে আইন প্রয়োগকারী আদালতের উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে (সি) ধারায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আইনটি ব্যবহারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আবার (ই) ধারায় যে কোন ১ম শ্রেণি ম্যাজিস্ট্রেট বা তাঁর পক্ষ হতে কোন কোন ম্যাজিস্ট্রেট এই আইনটি প্রয়োগ করতে পারবেন। আমাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এ উল্লেখিত তফশীলভুক্ত অপরাধের বিচার করেন। এর বাইরে তাঁর এখতিয়ার নেই। উল্লেখিত আইনটি মোবাইল কোর্ট আইনের তফশীল বহির্ভূত। এছাড়া জেলা প্রশাসক ও তাঁর অধস্তন ম্যাজিস্ট্রেটগণ অনধিক ২ বছরের সাজা দিতে পারেন, যা ৩য় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট সমমান। এখন প্রশ্ন- তারা কি এই আইনের ব্যবহার করতে পারবেন? অস্পষ্টতা থেকে যায়।
এছাড়া সহকারী জজ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাদের এখতিয়ারভুক্ত অপরাধগুলোর জন্য ‘প্রবেশন’ এর সুযোগ দিতে পারবেন না, যা অপরাধী ও সিনিয়র বিচারিক আদালতের উপর চাপ বাড়াবে।
চতুর্থত, অধ্যাদেশটির সপ্তম অধ্যায়ে ‘ফেইলিয়র টু অবসার্ভ কন্ডিশন অফ দ্য বন্ড’ এর ৩(ক) ধারায় প্রবেশনের শর্ত ভঙ্গের জন্য অনধিক এক হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমান সময়ের সাথে যা একেবারেই অসঙ্গতিপূর্ণ। আর যদি জরিমানা পরিশোধ করতে না পারে, তবে অপরাধী মূল অপরাধের জন্য শাস্তি পাবে, প্রবেশন সুবিধা প্রাপ্তির অপব্যবহার এবং প্রবেশন আইন ভঙ্গের জন্য নয়।
পঞ্চমত, অধ্যাদেশটির চতুর্থ ভাগে ‘কন্ডিশনাল ডিসচার্জ’ অংশের ৪(১) ধারায় আদালত ইতোপূর্বে ২ বছরের বেশি দÐিত নয় এমন অপরাধীকে প্রবেশনের জন্য মঞ্জুর করতে পারবেন নানা দিক বিবেচনায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে শর্ত, বন্ড ও প্রবেশন প্রকৃতি কেমন হবে তার কোন দিকনির্দেশনা নেই। ফলে প্রবেশনে থাকাকালীন অভিযুক্ত কী করবে, তাঁর অপরাধ মানসিকতা সংশোধন বা তাঁর পুনর্বাসন অথবা তার ইতিবাচক মানসিকতা বা ইতিবাচক চরিত্র গড়ে তুলতে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, এর কোন সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত দিক নির্দেশনা নেই। আরো নেই কোন ধরনের অপরাধের জন্য কত টাকা বন্ড বা অপরাধের ধরণ অনুযায়ী চুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কেও। ফলে আইনটির প্রয়োগে দেখা দেবে নানা অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা এবং অপব্যাখ্যা। এছাড়া আইনটির অপব্যবহারেরও সুযোগ আছে।
ষষ্ঠত, অষ্টম অধ্যায়ের ‘পাওয়ারস অফ কোর্ট ইন আপিল রিভিশন’ অংশে কোন আদালতে বা কার আদালতে আপিল অথবা রিভিশন করা যাবে, তার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। ফলে আপিল করা নিয়ে সাধারণ বিচার প্রার্থী যেমন হয়রানির শিকার হতে পারেন, তেমনি বিশৃঙ্খলার আশঙ্কাও কম নয়। সাম্প্রতিক সময়ের সব আইনে গুলোতে স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে কোন আদালত বিচার করবেন, কোন আদালতে আপিল করা যাবে এ বিষয়ে পরিষ্কার উল্লেখ থাকে। যদিও এ আইনে জামানত বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি ১২২, ৪০৬ (ক), ৫১৪, ৫১৪(৩), ৫১৫ ধারা কার্যকর করা হয়েছে। ৪০৬(ক) ধারায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর বিষয়টি আবারও সামনে আসে। এছাড়া ৫১৪ ধারায় জামানতের টাকা অনাদায়ের জন্য অপরাধীর সম্পত্তি ক্রোক ও বিক্রয়ের ক্ষমতা আদালতের হাতে দেয়া হয়েছে। অথচ সপ্তম অধ্যায়ের ৭ ধারা অনুযায়ী অনধিক এক হাজার টাকা জরিমানা কিংবা মূল অপরাধের সাজা দিতে পারেন।
কী ভজঘট অবস্থা!
সপ্তমত, এই আইনের দ্বাদশ অধ্যায়ে ‘এপয়েনমেন্ট অফ প্রবেশন অফিসারস; অংশের এক নং ধারায় ‘প্রবেশন অফিসার’ নিয়োগের ক্ষমতা ‘অফিসার-ইন-চার্জ’ এর হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এই অফিসার-ইন-চার্জ কি থানার নাকি অন্য কোন দপ্তরের সেটা উল্লেখ করা নেই। এতে দুর্বোধ্যতা তৈরি হয়। যদি ধরে নেই এটা থানার ওসি’র কথা বলা হচ্ছে, তবে তিনি তার অধীনস্ত পুলিশ কর্মকর্তাকেই প্রবেশন অফিসার নিয়োগ দিতে পারেন, অন্য কাউকে নয়। কিন্তু ‘বাংলাদেশ প্রবেশন অফ অফেন্ডার্স রুলস ১৯৭১’ অনুযায়ী প্রবেশন কর্মকর্তার যোগ্যতা ‘সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার’ বা সমাজ কল্যাণ বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পুলিশের ওসির কাছে সমাজ কল্যাণে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর করা অধস্তন কর্মকর্তা না থাকলে কী হবে, সেটা একটি প্রশ্ন। এছাড়া এটি পুলিশের দৈনন্দিন কাজের উপর একটি বোঝা হিসেবেই চাপানো হবে। এমনিতে সংশ্লিষ্ট মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একজন থাকবেনই। তাকে প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে সে যেমন প্রবেশনে থাকা অভিযুক্তের কাউন্সেলিং বা পুনর্বাসনে তেমন কোন অবদানই রাখতে পারবে না, কারণ এই সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ তাদের থাকে না। তেমনি একজনের পেছনে ব্যয় করার সময়ও তাদের নেই।
তাছাড়া আমাদের দেশে ‘প্রবেশন’ সম্পর্কিত অন্যান্য অবকাঠামো ও লোকবল এখনো পরিকল্পিত আকারে নেই। ফলে প্রবেশন অধ্যাদেশ দিয়ে ‘প্রবেশন’ কীভাবে কার্যকর হবে, কী কী কাজের মাধ্যমে অভিযুক্তের চারিত্রিক ও মানসিক পরিবর্তন সাধিত হবে, এবং কোন মানদন্ডের ভিত্তিতে বলা হবে অভিযুক্তের প্রবেশন সফল হয়েছে, সেটা অনুপস্থিত এবং অবোধগম্য।
এছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ আইনত প্রবেশন দেয়ার ও তদারকির ক্ষমতা না পেলে এই আইনের সুফল বৃহত্তর অর্থে পাওয়া যাবে না। কারণ মোবাইল কোর্টের আওতায় অনেক আইন রয়েছে যেখানে প্রথাগত জেল জরিমানার শাস্তি না দিয়ে প্রবেশন দিলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে এবং অপরাধ প্রবণতা হ্রাসে অবদান রাখা যাবে।
প্রবেশন আইন বিশ্বজুড়ে প্রচলিত। যুক্তরাষ্ট্র ১৯০৯-১৯২৫ সালের মধ্যে ৩৪ বার এই সম্পর্কিত বিল উত্থাপন করে, এবং ১৯২৫ সালে আইনটি চূড়ান্ত করে। যুক্তরাজ্য ১৯০৭ সালে ‘প্রবেশন অফেন্ডার্স এক্ট’ প্রণয়ন করেছে। যদিও তাদের আইন ততোটা বিশদ ও ব্যাখ্যা করা নয়। ফলে বাংলাদেশের সামনে একটি সুস্পষ্ট ,বিশদ ও অনুকরণীয় প্রবেশন গাইডলাইন সমৃদ্ধ আইন প্রণয়নের সুযোগ আছে। এতে যেমন দেশে অপরাধ প্রবণতা হ্রাসে নতুন গতি আসবে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমÐলে আইনটি সমাদৃত হবে।
এস,এম, নুরুন্নবী
৩৮তম বিসিএস প্রশাসনে সুপারিশপ্রাপ্ত