ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্ষক মুক্ত বাংলাদেশ চাই

‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’

সেই চির কল্যাণের অংশীদার নারীর মর্যাদা যেন আজ প্রতিনিয়ত লুণ্ঠিত হচ্ছে তার ভাইয়ের বয়সী, সন্তানের বয়সী কোনো দুর্বৃত্ত দ্বারা৷ রোজ সকালে সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখতে হচ্ছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের খবর৷ ধর্ষকের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছেন না শিশু, কিশোরী, মধ্যবয়সী, বিবাহিতা, জননী, বৃদ্ধা কেউই। এমনকি প্রতিবন্ধী, ভবঘুরে এবং পাগলও ধর্ষণের অসহায় শিকার হচ্ছেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয়মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন নারী। এর মধ্যে একজনের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬২ জন এবং গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন নারী। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী। গত ১লা অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংগঠনটি আরো জানায়, গত ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ জন নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানি কারণে ১২ নারী আত্মহত্যা করেছেন। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন নারী এবং ৯ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। এ সময়কালে দেশে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে।

সংস্থাটির হিসেব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২জন৷ অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী৷ এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬জনকে৷ আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০জন নারী৷

সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে এক বিধবাকে (৩৮) সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পরে ওই নারীকে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে ঘরের পেছনে ফেলে পালিয়ে যায় ধর্ষকরা। ৫ই অক্টোবর সকালে নির্যাতনের শিকার ওই নারী বাদী হয়ে রামগতি থানায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

চলতি মাসের ৩ তারিখ সন্ধ্যায় সিলেটের শামীমাবাদ এলাকায় ঘরে ঢুকে গণধর্ষণ করা হয় ৫ সন্তানের এক জননীকে। এর আগে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বখাটে যুবকদের অবৈধ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে দফায় দফায় শারীরিক নির্যাতন করা হয়। কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রাতে ঘরে ঢুকে ওই নারীর ওপর পৈশাচিকতা চালায় এবং ভিডিওচিত্র ধারণ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ঘটিত এ ঘটনায় ওই নারী ৪ঠা অক্টোবর বেগমগঞ্জ থানায় দুটি মামলা করেন। দুই মামলাতেই নয়জনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে ওই নারী অভিযোগ করেছেন, স্বামীকে বেঁধে রেখে আসামিরা তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ ঘটনায় ধারণকৃত ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে গত এক মাস তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়া হচ্ছিল।

ঘটনার ৩২ দিন পর অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এ পাশবিক নির্যাতনের ভিডিও। কিন্তু এ ঘটনায় এক মাসেরও বেশি সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী ছিল, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। অন্যদিকে কোনো মানবাধিকার সংগঠন আদালতের শরণাপন্ন না হওয়ায় হতাশাও প্রকাশ করেছেন উচ্চ আদালত।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্বামীর সঙ্গে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন নববধূ। সন্ধ্যায় তাদের কলেজ থেকে ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে যায় ৬-৭ জন দুর্বৃত্ত এরপর দুইজনকে মারধর করা হয়। একই সঙ্গে স্বামীকে আটকে রেখে তার সামনে স্ত্রীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে তারা।

এর আগে ২৩শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। মধ্যরাত আড়াইটার দিকে সদর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে এক প্রতিবন্ধী নারীকে (২৬) গণধর্ষণ করা হয়।

গত ৩০শে সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার পূর্ব শীলমন্দী এলাকায় ৭০ বছরের এক বিধবা বৃদ্ধা ঘর থেকে ওজু করতে বের হয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। রাত ৯টার দিকে ওজু করতে ঘর থেকে বের হলে অভিযুক্ত ধর্ষক তাকে পেছন দিক থেকে মুখ চেপে ধরে। এ সময় বসতঘরে কেউ না থাকায় বৃদ্ধার ঘরেই তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়।

এই পাশবিকতার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদ স্বরূপ গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রোফাইল ছবি, কভার ছবি পরিবর্তন করে একজন ধর্ষিতার প্রতিকী ছবি এবং পরবর্তীতে প্রোফাইল কালো করে ভার্চুয়াল প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা৷

সারাদেশে ধর্ষণের এই ভয়াবহ চিত্র কাঁদাচ্ছে প্রতিটি নাগরিককে, শঙ্কিত করছে নারীদের। অব্যাহত এই পৈশাচিক নির্যাতন এখনি বন্ধ করতে না পারলে, থমকে যেতে পারে নারী শিক্ষার অগ্রগতি। ঘৃণ্য এই অপরাধের বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার হতে হবে, তাৎক্ষণিক প্রতিহত করতে হবে। বৃদ্ধি করতে হবে সামাজিক সচেতনতা৷ অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর ব্যবহারকারীরা ভিকটিমের ছবি ছড়িয়ে সমবেদনাজ্ঞাপন করেন, প্রতিবাদ জানান। পক্ষান্তরে ভিকটিমের ছবি ছড়ানোর মাধ্যমে সামাজিক প্রেক্ষাপটে আরো হেনস্তার শিকার হতে হয় ভিকটিম ও তার পরিবারকে। বরং এক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, তাকে কোনো সহযোগিতা না করে, আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে সর্বোচ্চ শাস্তি। ধর্ষক যেন পালিয়ে কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাসায় আত্মগোপন করে থাকতে না পারে বরং তাকে তুলে দিতে হবে প্রশাসনের হাতে। মনে রাখতে হবে ধর্ষককে সহায়তার মাধ্যমে আপনিও এই ঘৃণ্য অপরাধীকে সহায়তা করছেন, ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত করছেন কোনো নারীকে৷

নারীদের তাদের প্রাপ্য অধিকার সমূহ দিতে হবে। নারীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রত্যেক নাগরিককে সোচ্চার হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে। সকলের মধ্যে নৈতিক, ধর্মীয়, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষকদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিচারপ্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।

প্রয়োজনে ধর্ষণ আইন পরিবর্তন করে, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে৷ ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতই পারে অব্যাহত এই ধর্ষণ রুখে দিতে, নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কোনো নারীকে একা পেলে বা তার অসহায়ত্বের সুযোগে, পুরুষের ভূমিকা যেন লোলুপ না হয়। বরং পরস্পর সৌহার্দ্য আর সহযোগিতার সম্পর্কই পারে, একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করতে।

লখেক: আব্দুল্লাহ আলম নুর
শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন