ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির
১. পূর্বকথা
চলছে বিশ্ব জুড়ে পরিব্যপ্ত বিশ্বায়ন, যার কবলে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হচ্ছে। এই বিশ্বায়ন বিশ্বের দেশসমূহের জন্য সুযোগ হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশের ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পশ্চাৎপদ জ্ঞানীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে এই প্রস্তুতি গ্রহণ সম্ভব নয়। সেজন্য দেশে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।
২. বিশ্বায়নের অর্থ
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, বিশ্বায়ন বলতে কী বুঝায়। বিশ্বায়ন হলো- দেশাভ্যন্তরীণ গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি আন্ত:দেশীয় প্রক্রিয়া, যাতে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে আন্ত:দেশীয় বিনিময় সম্পন্ন হয় বলে, এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া পূঁজিবাদের কবলে নিপতিত হওয়ায়, পূঁজিবাদী কুশলী দেশ ও বেনিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থনৈতিক শোষণের সুযোগ হিসাবে নিয়েছে। পূঁজিবাদী আদর্শের খপ্পরে পড়ে, বিশ্বায়ন কেবলমাত্র বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি দৈশিক গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তঃদেশীয় পরিসরে পরিব্যাপ্তি লাভ করেছে। এর ফলে সারা বিশ্ব একটি পরিব্যাপ্ত সমাজে পরিণত হয়েছে এবং অভিন্ন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ যুগপৎ অংশ গ্রহণ করছে, যার চালিকা শক্তি হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে-পূঁজিবাদী শক্তি।
এই বিশ্বায়নের ঘূর্ণাবর্তে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন সূচীত হচ্ছে, যার নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি রয়েছে পূঁজিবাদী শক্তির হাতে। সেজন্য বাংলাদেশ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে যতো না সুবিধা পাচ্ছে, তার চেয়েও বেশী অর্থ পাচার ও অপসংস্কৃতির প্রসার ইত্যাদি নানা অনাঙ্খিত বিষয়ের শিকারে পরিণত হচ্ছে। এর কারণ, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটিতে পূঁজিবাদী কুশলী দেশ ও বেনিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ থাবা বিস্তার করে আছে। এই পূঁজিবাদী কুশলী দেশ ও বেনিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহকে ডিঙ্গিয়ে দেশ ও জাতির জন্য সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সুবিধা আহরণ করতে হলে, বাঙ্গালি জাতিকে কৌশলগতভাবে প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু বর্তমান কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কোমল অবকাঠামোতে বিশ্বায়নের পূর্ণ সুবিধা আহরণের মতো কৌশলগত প্রস্তুতি সম্ভব নয়। সেজন্য বিদেশবিদ্যা ও বিদেশি ভাষায় পারদর্শী অঞ্চল ভিত্তিক চিন্তকবর্গ (Think Tank) গড়ে তুলতে হবে।
৩. বিশ্বায়ন সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার অবকাঠামো
দেশে বিদেশবিদ্যা ও বিদেশি ভাষায় পারদর্শী চিন্তকবর্গ গড়ে তুলতে হলে, শিক্ষা ও গবেষণা সম্পর্কিত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এখানে আমাদের জানা প্রয়োজন যে, অবকাঠামো বলতে কী বুঝায়। অবকাঠামো হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থাবর ও সংবিধি সম্পর্কিত ব্যবস্থা বিশেষ। অবকাঠামোসমূহকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: ভৌত অবকাঠামো ও কোমল অবকাঠামো। বিশ্বায়ন সম্পর্কিত শিক্ষা ও গবেষণামূলক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হলে, প্রয়োজন হবে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সহায়ক শিক্ষা ও গবেষণা ভবন, মিলনায়ন, গ্রন্থাগার, সম্মেলন কক্ষ ও বৈদ্যুত্যিক ও বৈদ্যুতিন সুবিধা সম্পর্কিত ভৌত অবকাঠামো, এবং নির্মিত এই ভৌত অবকাঠামোতে শিক্ষা ও গবেষণা কর্ম সম্পাদন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংবিধি, নীতিমালা ও আইন হলো কোমল অবকাঠামো। বিশ্বায়ন সম্পর্কিত চিন্তকবর্গ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও গবেষণা সম্পর্কিত অবকাঠামো সৃজন ও পরিচালনার জন্য গৃহীত পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে এক বা একাধিক বিদেশবিদ্যা বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়, যার নাম দেওয়া যেতে পারে― বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়। এই পরিকল্পনার আওতায়, দেশে বর্তমানে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান, যেমন-বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (Bangladesh Institute of International and Strategic Studies) সমূ্হকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি ও ভাষানীতির কোথাও এই বিশ্বায়ন সম্পর্কিত চিন্তকবর্গ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও গবেষণা সহায়ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বিবৃত নেই। অথচ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার আবর্তে প্রবাহমান থেকে এর থেকে সুবিধা নিতে দেশে এই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই প্রয়োজনীয়তাকে আমলে নেওয়া হলে, অন্তত একটি বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় ভৌত ও কোমল অবকাঠমো গড়ে তুলতে হবে। সরকারি উদ্যোগ ও অর্থ বরাদ্দ থাকলে সহজেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু এই অবকাঠামোতে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গড়ে তুলতে হবে একটি কোমল অবকাঠামো, যার অন্তর্ভুক্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধি, আইন ও নীতিমালা। কাজেই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ভৌত কাঠামো যত সহজে গড়ে তোল সম্ভব, কোমল অবকাঠামোটি গড়ে তোলা ততো সহজ নয়। সেজন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক পরিকল্পনাধীনে এরূপ কোমল অবকাঠামোটি গড়ে তুলতে হবে।
৪. প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা
প্রস্তাবিত বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে, শুন্য থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কারণ এ ধরণের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমল অবকাঠামো তৈরির উপাদান এ দেশে প্রায় অনুপস্থিত। এই উপদানগুলো হলো- শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় উপাদান, যার মধ্যে রয়েছে-শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা প্রশাসন। নিম্নে কোমল অবকাঠামোর এই উপাদানসমূহ পর্যায়ক্রমে পর্যালোচনা করে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি রূপরেখা তুলে হলো:
৪.১. শিক্ষক: বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণা জগতে বিদ্যমান বর্তমান কর্মশক্তি দিয়ে দেশে একটি বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সেজন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিদেশি মাতৃভাষী কর্মশক্তির উপর নির্ভর করতে হবে। সেজন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত সকল পদে বিদেশিদের নিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত রাখতে হবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে একটু ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় বিদেশি কর্মশক্তি নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এই ব্যবস্থায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি পণ্ডিতদের টানতে আকর্ষণীয় বেতন ও ভাতাসহ শিক্ষক পদের অতিরিক্ত গবেষক ও গবেষণা সহযোগী (Reseaerch Fellow)-এর মতো পদ সৃষ্টি করতে হবে।
৪.২. শিক্ষার্থী: প্রস্তাবিত এই বিশ্ববিদ্যালয় সব ধরণের বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তর জন্য উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন, যেন বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে মিথোষ্ক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমটি পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আবহে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় প্রবণতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের SAT-এর আদলে জ্ঞানীয় প্রবণতা পরিমাপক বাংলা-ইংরেজিতে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
৪.৩. পাঠ্যক্রম: পাঠ্যক্রম শিক্ষা কার্যক্রমের খু্বই গুরুত্ত্বপূর্ণ দিক। এই পাঠ্যক্রমে যে সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেগুলো হলো- বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিকবিদ্যা বা বিদেশবিদ্যা বিষয়ক শাস্ত্র এবং সে সব অঞ্চলে কথিত ভাষাসমূহ। আঞ্চলিকবিদ্যা বা বিদেশবিদ্যা হলো― কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, সামরিক শক্তি ও সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কিত জ্ঞান। বর্তমানে দেশে আঞ্চলিকবিদ্যা বা বিদেশবিদ্যা সম্পর্কিত শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম বিচ্ছন্নভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু বিদেশের কোন বিষয় সার্বিকভাবে বাংলা বা ইংরেজিতে লিখিত বা প্রচারিত হয় না। যদিও ইংরেজিতে লিখিত ও প্রচারিত হয়, তা লেখক ও প্রচারক নিজস্ব প্রয়োজনে ও নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে লিপিবদ্ধায়ন ও প্রচারণা সম্পাদন করে বলে, তা থেকে বাংলাদেশের জ্ঞাতব্য বিষয় প্রতিফলিত হয় না। কাজেই প্রস্তাবিত বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম দেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রণয়ন করতে হবে। সেজন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যম হবে বিদেশবিদ্যা সংশ্লিষ্ট বিদেশি ভাষা ও বাংলা ভাষা। এভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের বিষয় ও সে বিষয় অধ্যয়নের মাধ্যম- এই উভয়ই দেশজ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রণয়ন করতে হবে।
তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু প্রণয়ন করা যেতে পারে। বিষয় তিনটি হলো- ১)পাঠ্যক্রম সংশ্লিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চল, ২) পাঠ্যক্রমের জ্ঞানীয়, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উপযোগিতা, ৩) পাঠ্যক্রমের পরিধি। আমরা জানি যে, বিশ্ব ভৌগলিক অঞ্চল অনুসারে ৮টি মহাদেশে বিভক্ত। কিন্তু এর মধ্যে জনবসতিপূর্ণ ৬টি মহাদেশ হলো- এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ওসেনিয়া। রীতি অনুসারে এই মহাদেশগুলোর প্রত্যেকটিকে কয়েকটি উপমহাদেশে বিভক্ত করা যায়।
এ প্রসঙ্গে, এশিয়া মহাদেশকে উদাহরণ হিসাবে নিয়ে প্রস্তাবিত বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের একটি রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে। এশিয়া মহাদেশকে মোট ৫টি উপমহাদেশে ভাগ করা যায়। সেগুলো হলো- পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া। বিভিন্ন উপমহাদেশে জ্ঞানীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহ হলো- পূর্ব এশিয়ার জাপান ও চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, মধ্য এশিয়ার কাজাখাস্তান ও পশ্চিম এশিয়ার ইরান। জ্ঞানীয় কার্যক্রমের মাপকাঠিতে এ দেশগুলো বেশ এগিয়ে আছে বিধায়, এ দেশগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অধ্যয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহ হলো- পূর্ব এশিয়ার জাপান ও চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ এশিয়ার ভারত ও মধ্য এশিয়ার কাজাখাস্তান ও উজবেকিস্তান ও পশ্চিম এশিয়ার ইরান, সউদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কাজেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব দেশ সম্পর্কে সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। জ্ঞানীয় কার্যক্রম ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ গুরুত্বপূর্ণ এ সব দেশের কোনো কোনোটিতে বাংলাদেশীদের জন্য শ্রম বাজার উন্মুক্ত রয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-পূর্ব এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সকল দেশ। কাজেই প্রস্তাবিত উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখিত এ সব দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
একই ধারায়, আফ্রিকার বড় অর্থনীতির দেশসমূহ, যেমন- নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর ও আলজেরিয়া সম্পর্কিত বিদেশবিদ্যা অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দু’টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা হলো- ইংরেজি আর পরবর্তী দু’টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা হলো-আরবি। কাজেই আফ্রিকার দুই জোড়া দেশ সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত ইংরেজি ও আরবি ভাষায় পরিচালনা করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ, যেমন-তুরস্ক, স্পেন, জার্মানি ও সুইডেন ইত্যাদি জ্ঞানীয় কার্যক্রম ও অর্থনীতির নিরিখে বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে। কাজেই দেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব দেশ সম্পর্কিত বিদেশবিদ্যা ও ভাষা পাঠক্রমের অন্তুর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
অন্যদিকে কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন উপমহাদেশে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতমা হলো- প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যেমন- ভারত, বার্মা, থাইল্যাণ্ড ও নেপাল। প্রতিবেশী দেশের সাথে অবিরত নানা বিষয়ে বিভেদ লেগে থাকে। কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্য প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে বিভেদ মিটিয়ে নিতে হয়। কিন্তু প্রতিবেশীর সাথে বিভেদ মিটাতে প্রতিবেশীর চিন্তা-চেতনা ও নীতিগত অবস্থান সম্পর্কে জানতে হয়। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশের ভাষা, জনগোষ্ঠী, ভূগোল, অর্থনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকলে, সে প্রতিবেশী দেশের সাথে জ্ঞানীয়, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা ও অব্যাহত রাখা সহজতর হয়। সে অর্থে কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ বার্মা ও ভারত সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন হবে।
এভাবে উক্ত তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে, প্রস্তাবিত বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের নানা দেশ ও তার ভাষাসমূহ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হলে, বাংলাদেশের উপযোগী চিন্তকবর্গ সৃজনে সহায়ক শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভবপর হবে।
৪.৪. শিক্ষা প্রশাসন: প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোর আদলে গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এই শিক্ষা প্রশাসনে বিশ্বের মহাদেশ ও উপমহাদেশের বিভক্তি অনুসরণে অনুষদ ও বিভাগ গঠন করে তার অধীনে শিক্ষা কার্যক্রম ন্যস্ত করা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী- ৬টি জন অধ্যুষিত মহাদেশের নাম অনুসরণে ৬টি অনুষদ- এশিয়া অনুষদ, আফ্রিকা অনুষদ, উত্তর আমেরিকা অনুষদ, দক্ষিণ আমেরিকা অনুষদ, ইউরোপ অনুষদ ও ওসেনিয়া অনুষদ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। প্রত্যেক মহাদেশের অধীনে উপমহাদেশ অনুসরণে এক বা একাধিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সে অনুযায়ী এশিয়া অনুষদে বিভাগগুলোর নাম হবে- পূর্ব এশিয়া বিভাগ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগ, দক্ষিণ এশিয়া বিভাগ, মধ্য এশিয়া বিভাগ ও পশ্চিম এশিয়া বিভাগ। একই ধারায় প্রত্যেক বিভাগে অধীনে উপবিভাগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। যেমন- মধ্য এশিয়া বিভাগ তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাকাস্তান এই তিনটি উপবিভাগ নিয়ে গঠিত হতে পারে।
উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হলে, দেশে বিশ্বায়নে জ্ঞানসম্পন্ন চিন্তকবর্গ সৃজনে সহায়ক বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
৫. উপসংহার
কিন্তু উক্ত ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয় অনুপস্থিত থাকায়, দেশে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত কোন চিন্তকবর্গ গড়ে উঠেনি। সে জন্য ক্ষণে ক্ষণে বিচ্ছিন্নভাবে এখান থেকে বা ওখান থেকে বিদেশি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা শুনা যায়। কিছুদিন আগে বিদেশি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে শুনা গেলো শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে। এখন প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী বলছেন- ‘তরুণদের কেবল বাংলা বা ইংরেজি জানলে হবে না। সঙ্গে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ এবং চাইনিজ ভাষা শিখতে হবে। তাহলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ বেশি বেশি পেতে সুবিধা হবে। তাছাড়া শুধু ফ্রিল্যান্সিংয়ে নয়, বিদেশে আমাদের দেশের শ্রমিকদের চাহিদা বাড়বে (দৈনিক যুগান্তর ২৫শে আগস্ট ২০২০)’। এ ধরণের কথাবার্তা থেকে মনে হয় যে, দেশের নীতি-নির্ধারকগণ বিদেশি ভাষাকে শ্রমিকের ভাষা ব্যতীত আর কিছু মনে করেন না। অর্থ্যাৎ বিদেশি ভাষা সম্পর্কে এ ধরণের খণ্ড খণ্ড কথাবার্তা নীতি-নির্ধারকগণের বিশ্বায়ন সম্পর্কিত চিন্তাধারার দেউলিয়াত্বকেই প্রকাশ করে।
এ ধরণের খণ্ড খণ্ড চিন্তা দিয়ে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় সামিল হওয়া যাবে না। সেজন্য আদর্শ, নীতি ও পরিকল্পনা ইত্যাদি থেকে নতুন করে শুরু করতে হবে। একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠে, কোনো একটি বিদেশি ভাষানীতিকে ভিত্তি করে। আর বিদেশবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানচর্চার অবকাঠামো গড়ে উঠে একটি বিদেশবিদ্যানীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিদেশি ভাষা নীতি নেই এবং বিদেশবিদ্যা নীতিও নেই। কাজেই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে সুবিধা পেতে হলে দেশে একটি বিদেশি ভাষানীতি ও বিদেশবিদ্যা নীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং এই নীতির অনুসরণে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে, বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির
ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আনন্দবাজার/শাহী