নুরুদ্দিন আহমেদ
একজন রাজনীতিবিদ, মনে প্রাণে বাঙ্গালি, বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধু, ভারতের ইতিহাসে প্রথম কোন বাঙ্গালি অর্থমন্ত্রী, তিনি হচ্ছেন প্রয়াত প্রণব মুখার্জি। প্রণব মুখার্জি নামটি ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য নাম।ভারতের সংস্কৃতি, ভূ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতিতে তাঁর অবদান তাকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। গত সোমবার এই প্রজ্ঞাবান লোকটির ইহলোক জীবনের ইতি ঘটে। জীবদ্দশায় তিনি বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় রাষ্ট্রের জন্য আর্শ্বিাদ হিসেবে ছিলেন।
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। জনমানুষের সাথে তাঁর হৃদ্যতা ছিলো সুগভীর। সুহৃদই তাঁকে একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তুলেছিল। রাজনীতিটা তার রক্তের সাথে মিশে ছিলো। ওঁনার বাবাও ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন; সে-দিক থেকে একটা রাজনৈতিক বলয়ের মধ্য দিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন।
বিশিষ্ট ভারতীয় সাংবাদিক কৃষ্ণকুমার দাস তাঁর স্মৃতি থেকে বলেন, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সিডরে আক্রান্ত হয়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। আর তা পরিদর্শন করার জন্য প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে এসেছিলেন। সাংবাদিক কৃষ্ণকুমার দাস ওঁনার সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তিনি বলেন, সেদিন বরিশালের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রণব বাবু যে ছোট ভাষণটি দিয়েছিলেন তার কয়েকটা লাইন আজও মনের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বলেছিলেন, ‘সিডর শুধু বাংলাদেশের নয় বাঙালির হৃদয় তছনছ করে দিয়েছে।
শুধু বরিশাল বা বাগেরহাটের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হননি, আঘাত পেয়েছে বাঙালির সংসার, তাই আমরা ছুটে এসেছি।‘ সাংবাদিক কৃষ্ণ কুমার দাসের স্মৃতিকথা প্রমাণ করে; তিনি আপাদমস্তক মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন। ওপার বাংলা তাঁকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে পৃথক করতে পারেনি। বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে পূর্ববাংলার তুমুল যুদ্ধ বেধে গেলে ঐ বছরের ১৫ই জুন ভারতের রাজ্য সভায় তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য আর্জি জানান। ইন্দিরা গান্ধী তার বুদ্ধিদীপ্ত, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক মনোভাবে সন্তুষ্ট হয়ে তার প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে বাংলাদেশের যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তুলে ধরা ও বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন লাভের জন্য সর্বাতœক চেষ্টা করেছিলেন।
তার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের যে ঋণ তা অপরিসীম। ইতিহাসের তাঁর নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ২০১৩ সালে তিনি কংগ্রেস থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম সফর দেন বাংলাদেশে। বৈবাহিক সূত্রেও তিনি বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের নড়াইলের শুভ্রা মুখার্জীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের সাথে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অটুট বন্ধন রেখে গিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা হন। বিদেশে থাকার কারণে এ যাত্রায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য যে বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর সংগ্রাম করেছেন, জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন; তারই কন্যাদের স্থান হলো না বাংলাদেশে,নিজের দেশে হয়ে গেলেন ভিনদেশী। দেশে আসার সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হল। তাঁদের জীবনের এই করুণ মুহূর্তে এগিয়ে আসেন প্রণব মুখার্জি ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল, দীর্ঘ এ সময় তারা প্রণব মুখার্জির আশ্রয়ে ভারতে ছিলেন। সে সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করেছিলেন। সে-ঋণ শোধ হবার নয়। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী খুব মর্মাহত হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িতদের উপর্যুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য তিনি ভারতে চলে যান।
বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষদের ভারতে নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন এবং এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে থাকেন। তখনোও তার দিকে প্রণব মুখার্জি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। যদিও পরবর্তীতে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় চলে গেলে, মেজর জিয়া বিজেপি সরকারের সাথে চুক্তি করে তাঁর সৈন্যদেরকে ভারত থেকে এনে হত্যা করতে শুরু করে। ফলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সকল কর্মপরিকল্পনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। এছাড়াও, প্রণব মুখার্জি ২০০৮ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাগারে আটক থাকা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিøউ বুশের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন।তাঁর লিখা ‘দ্য কোয়ালিশ ইয়ারসথ বইয়ে তিনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
প্রণব মুখার্জি ২০১৩ সালের বাংলাদেশ সফরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বকতৃতার এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা এবং আমি এর ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মভূত করেছি আমার স্ত্রীর জন্ম নড়াইলে এবং এখানেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। আমি বড় হয়েছি আপনাদের মতো একই সাহিত্যিক ও কবিদের লেখা পড়ে, সেসব গান শুনে যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ ভালোবাসেন, ঘুরে বেড়িয়েছি একই নদীর তীরে, যা একই রকম গানের জন্ম দেয়, যা আমাদের মনকে একই রকমভাবে ভাবিত করে তোলে।‘ সর্বশেষ ২০১৮ সালের বাংলাদেশ সফরে একজন সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার জীননের সেরা মুহূর্ত কেনটি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের মুহূর্তটি রাজনৈতিক জীবনে সেরা মুহূর্ত। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহ্মাননা প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট(ডক্টর অব লেটারস)উপাধিতে ভূষিত করে।উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ব্যক্তি প্রণব মুখার্জি অমর হয়ে থাকবেন। প্রতিটি বাঙ্গালির মনে অপার ভক্তির সাথে স্বরণীয় ও বরণীয় হয়ে বেঁচে থাকবেন কাল থেকে কালান্তরে। বিনম্র শ্রদ্ধা।
শিক্ষার্থী; লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়,বাংলাদেশ।
সদস্য; বাংলাদেশ তরুণ লেখক ফোরাম, কুবি শাখা
nuruddincou111@gmail.com