ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাজীপুরে বেদখল হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বন

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের গাজীপুর। এ দেশের প্রকৃতির সাথে মিশে আছে গাজীপুরের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। যে প্রকৃতি এ জেলাকে রূপময় করেছে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাওয়ালের বনভূমি এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থা।

এদিকে, অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ নিধন, নগরায়ণ, শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপন এবং পরিবেশ দূষণের কারণে গাজীপুর অঞ্চলের প্রকৃতি ও বন হুমকির সম্মুক্ষীন। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে গাজীপুর জেলা রাজধানী ঢাকার পাশে এবং শিল্প-কারখানা স্থাপনের উপযোগী উচু ভূমি। শিল্প উদ্যোক্তারা বনের ভেতর অল্প জমি ক্রয়ের পর কয়েক গুণ বেশী বনের জায়গা দখলের পর প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থাপনায় কারখানা গড়ে তুলে। প্রায়ই শোনা যায় বনের জায়গা বেহাতের সাথে জড়িত প্রভাবশালী মহল এবং বন রক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা।

আর এসব কারখানার অপরিশোধিত বিষাক্ত তরল বর্জ্যরে সরাসরি গন্তর্ব্য উন্মুক্ত জলাশয়। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি প্রাকৃতিক জলাশয় তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালুনদী ও মৎস্য ভান্ডার খ্যাত ‘‘বেলাই বিল’’ দূষিত করছে। উন্মোক্ত এসব জলাশয় এখন জলজপ্রাণি শূন্য।

পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আইন-কানুন, বিধি এবং নীতিমালার মজবুত কাঠামো রয়েছে। সরকার ১৯৯২ সালে পরিবেশ নীতি, ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা এবং ২০০০ সালে পরিবেশ আদালত বলবৎ করে। ২০১০ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ কে সংশোধনপূর্বক হালনাগাদ করে সরকার। পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ জারি করে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণকারী যে কোনো ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানের বিরূদ্ধে মামলা দায়ের করার অধিকার জনগণের নিকট অর্পণ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের জাতীয় বন নীতি জারী রয়েছে।

বনের জমি দখল এবং বন উজার হয়ে যাওয়ায় গাজীপুরের বনে এখন আর আগের মতো দেখা যায় না বণ্য পশু ও পাখি। তাইতো কয়েক বছর ধরে দাবী ওঠেছে ‘বন্য প্রাণী বাঁচাতে আগে বাঁচাই বন’। আমাদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন যৌগের ব্যবহার, বৃক্ষনিধন, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ মানবসৃষ্ট নানাবিধ কারনে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে।

জনগণকে সচেতন করতে বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করে আসছে। দেশব্যাপী বনা লের সুরক্ষা এবং বৃক্ষরোপনের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও গাজীপুরের বন ও বনভূমি বেহাত হচ্ছে প্রতিদিন।

পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মহানগর এলাকায় ইটভাটা অবৈধ। হাইকোর্টের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সিটির ভেতরের সকল ইটভাটা বন্ধ সহ জেলার ২৬৬ টি অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসময় মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নের্তৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে চার কোটি এক লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। অনাদায়ে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদন্ডও দেয়া হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, পরিবেশ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট থাকলে জরিমানা আদায়ের পরিমান আরো বাড়ত। পরিবেশ কর্মকর্তারা মনে করেন, জেলায় ছোট- বড় দশ হাজারের বেশী শিল্প-কারখানার কার্যক্রম তদারকি করতে আরো বেশী জনবল দরকার। বনের জমি বেহাত ও প্রকৃতি ধ্বংস, জলাশয় ভরাট এবং কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে জলজপ্রাণি বিলুপ্তি সহ পরিবেশের ক্ষতি এবং ক্ষতি হতে পারে এমন অভিযোগে মামলা করেও সুফল মিলছে না। জলাশয় ভরাট এবং পরিবেশ দূষণ সহ নানা অভিযোগে গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় ৫ টি মামলা দায়ের এবং আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে আদালত চার্জ গঠন করার পর দু’টি মামলা অভিযুক্তরা গাজীপুর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করে।

পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুর অফিসের পরিদর্শক শেখ মুজাহীদ বলেন, মামলা স্থানান্তর হয়ে গেলে আমাদের আর কিছুই করার থাকেনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দায়িত্বশীল সুত্রের তথ্য, শিল্প অধ্যুষিত এই জেলায় পরিবেশ দূষণ রোধ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় দ্রুত সুফল পেতে হলে বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন।

পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুস ছালাম সরকার মনে করেন, দেশের অনেক জেলার চেয়ে গাজীপুরে শিল্প-কারখানা বেশী এবং পরিবেশ সুরক্ষার কাজও বেশী। ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজার পরিমাণ সীমিত। বেশী পরিমান পরিবেশ আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ফাইল বা নথি ঢাকায় পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে সময় ক্ষেপণ হয়। বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয় স্থাপন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।

টেকসই উন্নয়নে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সময়ের দাবী। বন রক্ষায় সচেষ্ট নন বন কর্মীরা এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বনের জমি উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলে কথা আছে। গাজীপুরে কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষণ, জলাশয় ভরাট সহ নানা অভিযোগ অহরহ।

সরেজমিনে দেখতে গেলে গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া ঢাকা বন বিভাগের মনিপুর বিট অফিসের কাছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে পলাশ খাবার হোটেল সরকারী বন ও বনের জমি দখলের চিএ ভেসে উঠে।

এদিকে দখল পজিশনকৃত বনের জমির বিষয়ে জানতে চাইলে শাপলা হোটেলের মালিক আব্দুস সাত্তার জানান, আমি এই জমি স্থানীয় ফারুক ভূইঁয়া নামক ব্যক্তির কাছ থেকে দুই লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে দখল পজিশন ক্রয় মালিকানা বুজে নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনিপুর ফরেস্ট বিটের বিট কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ সাংবাদিকদের জানান, বন ও বনের জমি রক্ষায় আমরা বন বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরো জানান, বনের জমি যদি পূর্বের দখলে থাকে তাহলে আমরা তা উচ্ছেদ করে দেই।

প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় গাজীপুরে পরিবেশ আদালত স্থাপন করা দরকার। একই সাথে বন আইন ১৯২৭ কে সংশোধনপূর্বক যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া জরুরী।

আনন্দবাজার/শাহী

সংবাদটি শেয়ার করুন