অধ্যাপক ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির
১. উপক্রমণিকা
যে কোনো দেশেই একটি ভাষার অস্তিত্ত্ব থাকলে তার সাথে তার আঞ্চলিক বুলি বিরাজমান থাকে। বাংলাদেশে নদীয়া-মুর্শিদাবাদের ভাষাকে মান ভাষা বলে মেনে নেওয়া হয়। কারণ কলকাতার প্রমিত বাংলা ভাষা মূলত: নদীয়া-মুর্শিদাবাদের বাংলা ভাষার কাঠামোতে নির্মিত। ভাষাতত্ত্বের সূত্রানুযায়ী মান ভাষার বিপ্রতীপে আঞ্চলিক বুলিগুলো বুলি-শৃঙ্খল তৈরি করে, যাতে প্রত্যেকটি বুলির বিচ্যুতির মাত্রা স্থানিক দূরত্বের উপর নির্ভর করে। বাংলা মান ভাষার কেন্দ্র থেকে সিলেটের স্থানিক দূরত্ব বেশী হওয়ায় এই সিলেটের আঞ্চলিক বুলির মান বুলি থেকে বিচ্যুতি বেশী। কিন্তু সিলেটি নিজে কোন মান ভাষা নয়।
২. বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ‘সিলেটি’ বুলিকে ভাষা অভিধা আরোপ
সিলেটি একটি আঞ্চলিক বুলি এটি কোন ভাষা নয়। তা সত্ত্বেও বিবিসি বিগত কয়েক মাস যাবত সিলেটি বুলিকে ভাষা হিসাবে প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ (২০ মে)
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস তার এক সম্প্রচারে করোনা ভাইরাস-এর সতর্ক বার্তা এমনভাবে প্রচার করেছে যে-মনে হয় যেন সিলেটি বুলি বাংলা ভাষার সমমর্যাদার কোনো একটি ভাষা। এই সম্প্রচারে বাংলা, উর্দু, হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি ও তামিল ভাষার সাথে এক কাতারে সিলেটি বুলিতে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সতর্কবার্তা প্রচার করে। সিলেটি বুলিকে বাংলা ভাষার মতো সমতূল্য ভাষা হিসাবে দেখানোর বিষয়টি একটি অনভিপ্রেত ঘটনা। কারণ এই ধরণের স্বীকৃতি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
৩. বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শুরু
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শুরু কয়েক দশক আগে। গত দুই দশক আগে খ্রিস্টান মিশনারি অধ্যুষিত সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুয়িস্টিকস(SIL)নামক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরে যে, বাংলাদেশে ৪০/৫০টি ভাষা কথিত হয়ে থাকে। এই ওয়েবসাইটে বলা হয় যে, বাংলাদেশে বাংলা ছাড়াও রংপুরী, সিলেটি ও চাঁটগাঁইয়াসহ অনেক ভাষা কথিত হয়ে থাকে, যে কারণে বাংলা ভাষাভাষী লোকের জনসংখ্যা সাড়ে ৮ কোটির মতো।
সেই গবেষণার ফলাফল নানা ওয়েবসাইটে শোভা পাচ্ছিলো। সেগুলো ব্যবহার করে আরো নতুন প্রবন্ধ লেখা হচ্ছিলো। কিন্তু যে গবেষণার ভিত্তিতে তাঁরা একথা বলেছিলো, সেই গবেষণায় যেমন রয়েছে তাত্ত্বিক কাঠামোতে ভুল, তেমনি রয়েছে গবেষণার পদ্ধতিগত ভুল। কাজেই আমি রংপুরী, সিলেটি ও চাঁটগাঁইয়া বুলিকে ভাষা অভিধা আরোপ করার বিষয়টি ভ্রান্তিপূর্ণ বলে জানিয়ে ই-মেইল করি। সেই সূ্ত্রে SIL-এর সাথে আমার সংজ্ঞাপন চলতে থাকে। সেসময় তারা আমার কাছে রংপুরী, সিলেটি ও চাঁটগাঁইয়া ভাষায় রেডিও সম্প্রচার চালুর ব্যাপারে পরামর্শ চায়। কিন্ত আমি তখন তাঁদের ধারণা ভুল প্রমাণে সক্ষম হয়েছিলাম এবং একটি সন্দর্ভ http://(http://bup.edu.bd/assets/uploads) রচনা করেছিলাম। তারপর তাঁরা তাঁদের ওয়েবসাইট সংশোধন করে আঞ্চলিক বুলিগুলোকে ভাষা হিসাবে দেখানো বর্ণনা অপসারণ করে।
৪. সিলেটি বুলি প্রকল্প
সিলেটি বুলিকে ভাষায় উন্নীত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে University of London এর অন্তর্ভুক্ত School of Oriental and African Studies-এর অধিভুক্ত Sylheti Project – SOAS in Camden নামক একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের মুখপাত্র হলো মিজ Marie Thaut।এই প্রকল্প সিলেটি বুলিকে ভাষায় উন্নীত করার অনকূলে নানা রকম তথ্যের সমাহার ঘটিয়েছে এবং অবিরত একে ভাষায় উন্নীত করার নানা চেষ্টা ও তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যত: বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস এই প্রকল্পের কর্ণধারদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলা, উর্দু, হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি ও তামিল ভাষার সাথে এক কাতারে সিলেটি বুলিতে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সতর্কবার্তা প্রচার করেছে। সিলেটি বুলিকে বাংলার সাথে এক কাতারে উপস্থাপনের মোজেযা হলো-বাংলা ও সিলেটি দুটি ভিন্ন ভাষা।
আমি Marie Thaut কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে কয়েক মাস আগে তাঁদের পরিচালিত ফেসবুক গোষ্ঠিতে যোগ দেই। আমি সে ফেসবুক গোষ্ঠিতে যোগ দিয়ে আমার গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করি যে, সিলেটি কোনো ভাষা নয়। তখন সে গোষ্ঠির কয়েকজন সরাসরি আমার সাথে যুক্তিতর্ক না করে, বেশিরভাগ সময় ব্যঙ্গক্তি দ্বারা নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
৫. বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালি জাতীয়াবাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র?
একটি ভাষা হলো- একটি জাতির জাতীয়তাবাদের প্রতীক। ভাষাগত প্রতিসমতা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিয়ামক। ভাষাগত বিভাজনে কোন জাতির মধ্যে বিভেদের দেওয়াল তৈরি হয় এবং জাতির মধ্যে ফাঁটল দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দিতে পারে। কাজেই বাংলা ভাষার বিভাজনের প্রচেষ্টা বাঙ্গালি জাতির মধ্যে বিভেদ উস্কে দেওয়ার সামিল।
কাজেই বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস সিলেটি বুলিকে ভাষা অভিধা আরোপ করার ফলে বাংলাদেশের ভাষাগত সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। কোন গণমাধ্যমের অন্য দেশের বুলিকে ভাষা বানানোর সুযোগ নাই। এই সুযোগ থাকলে বিদেশি গণমাধ্যম অন্য দেশের বুলিগুলোর প্রত্যেকটির জন্য আলাদা সম্প্রচার কেন্দ্র খুলতে পারবে এবং অন্য দেশের ভাষাগত প্রতিসমতা নষ্ট করার সুযোগ পাবে। কাজেই যে কোন বিদেশী শক্তি ভাষা সমস্যায় জর্জড়িত দেশগুলোর জনগণের ঐক্যে ফাঁটল ধরানোর কাজে এই সুযোগ ব্যবহার করতে পারবে।
৬. ভাষা বিজ্ঞানের নিরিখে বুলি-ভাষা দ্বৈত সমস্যার সমাধান
কোন দেশে বিরাজিত বুলি-শৃঙ্খলের সবগুলো আঞ্চলিক বুলিকেই ভাষায় উন্নীত করা সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন ভাষানীতির অনুসরণে ভাষা-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। সেজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক আদর্শ। একই হিন্দুস্থানী ভাষা ধর্মীয় আদর্শগত বিভেদের কারণে হিন্দী ও উর্দু নামক দু’টি ভাষায় পরিণত হয়েছে। অনুরূপভাবে, দুই কোরিয়া সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র কেন্দ্রিক রাজনৈতিক আদর্শগত বিভাজনের কারণে বিভক্ত হয়ে, একই ভাষার দু’টি বুলি দু’টি ভিন্ন ভাষা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে কথিত জামালপুরী বুলি, হবিগঞ্জী বুলি ও কুমিল্লা বুলিসহ ইত্যাদি সমস্ত আঞ্চলিক বুলিকেই ভাষায় পরিণত করা সম্ভব। সেজন্য প্রত্যেক জেলার জনগণকে তাদের বুলিকে ভাষায় উন্নীত করার রাজনৈতিক দাবী উত্থাপন করতে হবে এবং দাবী গৃহীত হলে এ দাবীর অনুকূলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হবে। তারপর বিষয়টির অনুকূলে সংসদে আইন প্রণয়নের হলে বুলিগুলোর ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যম অন্যদেশের কোনো আঞ্চলিক বুলিকে ভাষা বলে প্রচার করলে, তা হবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নামান্তর। কাজেই বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সিলেটি বুলিকে বাংলা ভাষার সমতূল্য হিসাবে দেখানোর বিষয়টি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সামিল।
৭. শেষকথা
বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আপাত:দৃষ্টিতে দেশের নীতি-নির্ধারকরা এ বিষয়ে নির্বিকার রয়েছেন। কারও কোন টনক নড়ছে না। কিন্তু বাংলা ভাষা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। এর বিভাজন জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। কাজেই দেশের বিরুদ্ধে পাঁকানো যেকোনো ভাষাগত বিভাজনের ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলার যুগপৎ দায় বর্তাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর।
লেখক: অধ্যাপক ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির
জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ
ই-মেইল: razaul_faquire@du.ac.bd
আনন্দবাজার/শাহী