ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গিবতের পরিণাম ভয়াবহ

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ খান

গিবত বা পরচর্চা একটি জঘন্য গোনাহের কাজ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এটাকে আমরা তেমন কোনো গোনাহই মনে করি না। এটি যে মারাত্মক গোনাহ এবং এর পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ, সে অনুভূতিটুকুও আমাদের অন্তর থেকে মুছে গেছে। যার কারণে আমরা একে অন্যের গিবত বা পরনিন্দা করে থাকি অহরহ। কোরআন-হাদিসে এ সম্পর্কে অনেক হুঁশিয়ারি এসেছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা পরস্পরের গুপ্তচরবৃত্তি ও গিবত কর্মে লিপ্ত হয়ো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? নিশ্চয় তোমরা তা ঘৃণা করো।’ (সুরা হুজরাত-১২)

গিবতের ভয়াবহতার ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) আরেক হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা গিবত করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, গিবতের মাঝে তিনটি ক্ষতি রয়েছে: ১. গিবতকারীর দোয়া কবুল হয় না। ২. গিবতকারীর কোনো নেক আমল কবুল হয় না। ৩. আমলনামায় তার পাপ বৃদ্ধি হতে থাকে।’

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমি তামার নখবিশিষ্ট একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তারা তাদের নখগুলো দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত খেত এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গিবত ও চোগলখোরি করত। (আবু দাউদ)

শরিয়তের দৃষ্টিতে গিবত হলো কারও অনুপস্থিতিতে তার এমন কোনো দোষ-গুণ বর্ণনা করা, যা শুনলে সে কষ্ট পাবে। চাই সে মুখের দ্বারা তার গিবত করুক অথবা কলমের দ্বারা কিংবা কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা নতুবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে সেটি গিবত হিসেবে বিবেচিত হবে। সমালোচিত ব্যক্তি চাই মুসলিম হোক বা কাফের হোক, সেটা গিবত হিসেবেই সাব্যস্ত হবে। যদি এমন কোনো দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে নেই, তাহলে সেটা হবে ‘তোহমত, অপবাদ’। যা গিবতের চেয়েও জঘন্য। বিষয়টি একাধিক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সারকথা হলো, কারও অগোচরে তার দোষারোপ করা, কুৎসা রটনা, সমালোচনা করা, পরচর্চা করা, পরনিন্দা করা।

একবার হজরত আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সাফিয়্যাহ বেঁটে আকৃতির মেয়ে, তা সত্ত্বেও আপনি তাকে ভালোবাসেন?’ এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারা কালো হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আয়েশা! তুমি আজ এমন একটি কথা বলেছ, যা সমুদ্রের পানিতে মেশালে পানি কালো হয়ে যেত।’ (আবু দাউদ)

উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে গিবতের ভয়াবহতা খুব সহজেই অনুমেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে গিবত করা যেমন নিষেধ, তেমনি গিবত শোনাও নিষেধ। যে গিবত শোনে, সেও গিবতের পাপের অংশীদার হয়ে যায়। কেননা এ প্রসঙ্গে হাদিসের ভাষ্য হলো, যখন কেউ আপনার সঙ্গে বসে অন্যের গিবত করে, তখন তাকে থামতে বলুন, আল্লাহর হুকুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাবধান করুন। আর তাতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে সেখান থেকে উঠে আসুন।

গিবতে শুধু পরকালীন ক্ষতিই নয়, বরং সামাজিক ক্ষতিও রয়েছে। গিবত-চোগলখোরির ফলে পরস্পরের মাঝে সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টি হয়। একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোন্দল তৈরি হয়। এমনকি আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পরস্পরের মাঝে সুখ-শান্তি নষ্ট হয়। সমাজে মানুষের সম্মানহানি ঘটে। অথচ এ ক্ষেত্রে শরীয় বিধান হলো, কোনো মুসলমানের দ্বারা যেন অপর মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও সম্মানহানি না হয়।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা গিবত-পরনিন্দা থেকে সাবধান থেকো, কেননা গিবত অবৈধ যৌনাচারের চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্য পাপ।’ অর্থাৎ ব্যভিচার করে খাঁটিভাবে তওবা করলে আল্লাহ হয়তো ক্ষমা করে দিতে পারেন; কিন্তু গিবতের দ্বারা অর্জিত গোনাহ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি তথা যার গিবত করা হয়েছে, সে ব্যতীত ক্ষমার শরিয়তে কোনো মাধ্যম নেই। গিবতকারীর তওবা ও অনুশোচনা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। তাই বলা হয়েছে, গিবত ব্যভিচারের চেয়েও নিকৃষ্ট। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ ধরনের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: প্রবন্ধকার ও অনুবাদক

সংবাদটি শেয়ার করুন