শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ নিতে পারে আফ্রিকান চার অভিজ্ঞতা

করোনা রুখতে আফ্রিকার মানুষের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার অনেক কিছুই নিতে পারি। তাদের রয়েছে ইবোলা, জিকা কিম্বা চিকনগুণিয়ার মত বেশ কিছু ভয়াবহ অসুখ মোকাবিলার সফল অভিজ্ঞতা।

শিক্ষা এক :

দ্রুত স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি তথা সমাজনেতাদের জড়িত করতে হবে এই সংক্রমণ বিস্তার ঠেকানোর পদ্ধতি বাস্তবায়নে।

২০০০ সালের প্রথমে বিশ্বের প্রায় ৯৯ শতাংশ এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ে পোলিও নামের এক ভয়াবহ অসুখ। বিপর্যয়কর এই অসুখটি বলা হয়েছিল ২০ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ। মানুষের পঙ্গুত্ব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত

ঘটানোর মত এই রোগটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্টসহ হাজারো মার্কিনীকেও আক্রান্ত করেছিল।

তবে ২০০২ সালের দিকে নাইজেরিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পোলিও। এতে আক্রান্ত হয় দেশটির ২০১ জন মানুষ। এই পোলিও ২০০৩ সালের জুলাই ও ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে দেশটির বাউচি, কাদুমা, কানো, নাইজার ও জামফারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে চরমভাবে। বিশেষ করে এর প্রতিষেধকে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে এমন গুজবে মানুষের টিকা নিতে অনিহায় এই রোগের বিস্তার ঘটে দ্রুত।

সেই সময়ে গবেষকরা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সমাজ নেতাদের পরামর্শেই মানুষ এই টিকা নিতে রাজী হয়নি। সংশ্লিষ্টরা এমন যুক্তি দেখালেন, স্থানীয় নেতা ও সমাজপতিদের বাদ দিয়ে উপর থেকে নিয়ে যাওয়া ব্যয়সাধ্য এই টিকা কর্মসূচি সফল করা মোটেও সম্ভবপর হবে না।

গবেষকদের এসব অভিজ্ঞতা ও যুক্তি আমলে নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, গোষ্ঠিপতি ও বিজ্ঞানীদের এসব টিকাদান কর্মসূচিতে যুক্ত করলেন দেশটির কর্তৃপক্ষ। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় ইতোমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেছে।

আরও পড়ুনঃ  নতুন কর্মসূচি দিয়ে শহীদ মিনার ছাড়লেন শিক্ষার্থী-জনতা

এরপর ২০১২ সালে এই অসুখটি আবার দেখা দেয় নাইজেরিয়াতে। আর সংখ্যার দিক থেকে তা ছিল গোটা বিশ্বে পোলিও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। দেশকে সম্পূর্ণভাবে পোলিওমুক্ত করতে তখন দেশটির সময় লাগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। আর মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়ে যায় কোন রোগবিপর্যয় ঠেকাতে স্থানীয় নেতৃত্বের সংশ্লিষ্টতার বিকল্প নেই।

শিক্ষা দুই :

আক্রান্ত ছাড়াও অন্যদের অসুস্থতাও বিবেচনায় আনতে হবে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল সময়ে এবোলা মোকাবিলায় কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এটা করেছিল।

ভয়াবহ এবোলা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ সুদানে। এরপর ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল সময়ে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে আক্রান্ত হয় ৩ হাজার ৪৪৪ জন। কঙ্গোর মানুষদের কাছে এবোলা হুমকি হলেও তা দেশটির সবার জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ২০১৯ সালে কঙ্গোতেই এবোলা আক্রান্তদের সেবা করতে গিয়ে মারা গেছে ৩শ’র বেশি স্বাস্থ্যকর্মী। আর এই বিষয়টিই সবাইকে জানাতে হবে, আক্রান্তদের পাশাপাশি সেবাকারীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও আমাদের সচেতন হতে হবে। এটা করা না গেলে ব্যর্থতাই হবে শেষ পরিনতি।

শিক্ষা তিন :

অসুস্থকে দোষারোপ নয়, অথবা অসুস্থতার জন্য সমাজের নির্দিষ্ট কোন পক্ষকে দায়ী করা যাবে না। এটি করা হয়ে থাকে এইচআইভি/এইডসের ক্ষেত্রে।

গেল বিশ শতকেই এইচআইভি/এইডসে মারা গেছে ৩ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ে এই এইচআইভি/এইডস সবথেকে ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকট। প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষ এই অসুখে আক্রান্ত এবং এই অসুস্থতা নিয়েই জীবন পার করছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এইচআইভি/এইডস একটি জটিল স্বাস্থ্যসমস্যা হলেও তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অনেকেই এই অসুস্থতা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে আছেন। এরপরও এই অসুস্থতা নিয়ে সমাজে নানা ধরনের কুসংস্কার রয়েই গেছে। অনেকেই এখনো জানেন না বা মানতে চান না, এটি মোটেও ছোঁয়াচে কোন অসুখ নয়।

আরও পড়ুনঃ  সবজির দাম কমলেও বেড়েছে শস্যজাত পণ্যের দাম

তারপরও সমাজে অপাঙ্তেয় হওয়ার ভয়ে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন কি না তা জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এমনকি চিকিৎসাও নিতে চান না। গেল বছরের তথ্য বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই নতুন করে বিশ্বজুড়ে ১৭ লাখ মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

কিন্তু করোনার সংক্রমণের পথপদ্ধতি এইচআইভির মত না হলেও এ নিয়েও রয়েছে বেশ ভুল ধারণা। মোট কথা, রয়েছে সমাজে অবেহেলিত হওয়ার ভয়। ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার মত দেশগুলোতে মনে করা হচ্ছে কেবল বিদেশিরাই করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছেন। আর ইতালি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সবখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে এশিয়রাই প্রাণঘাতি এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য কেবল দায়ী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানম ঘেব্রেইয়েসস তো বলেইছেন, ‘আমরা এই সময়ে সবথেকে বড় প্রতিপক্ষ বলে যাকে মনে করছি তা ভাইরাস নয়, সেটি হচ্ছে স্টিগমা বা কলঙ্কিত হওয়ার ভয়। যেটি কিনা আমাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সহায়তা করছে।’

শিক্ষা চার :

জরুরি স্বাস্থ্যদুর্যোগ ও স্বাস্থ্যসেবায় শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক মত নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হয়। সুদানের দারফুরে ২০১২ সালে হলুদ জ্বর মোকাবিলায় এটি করা হয়েছিল।

দারফুরে ২০১২ সালে যে হলুদ জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল তা ছিল আফ্রিকার গেল ২০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। এই ভাইরাসটি সংক্রমিত হয় মূলত মশার মাধ্যমে। আর এটি হলে আক্রান্তের ভয়াবহ রক্তক্ষরণ হয়। আফ্রিকা থেকে শুরু হলেও বিশেষ করে দাস ব্যবসার মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে এটি ছড়ায় আমেরিকায়। পুরো অসমর্থ করে তোলে গোটা ফিলাডেলফিয়া শহরকে। মারা যায় শহরের মোট মানুষের প্রায় ১০ শতাংশ। বাকিদের সরিয়ে নেওয়া হয় অন্যত্র।

আরও পড়ুনঃ  কালবৈশাখীর পূর্বাভাস

দারফুরে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে সংঘাত চলে আসছে বেশ অনেক বছর ধরে। যদিও ২১০২ সালের দিকে এই সংঘাতের অনেকটাই মিটে গেছে বলে ধারণা করা হয়। তবুও দেশটিতে অন্যদের যাওয়া-আসা সাংঘাতিকভাবে সীমিত করে রেখেছে দেশটির কর্তৃত্ববাদী সরকার। বিশেষ করে দেশটির স্বর্ণ খনি অধ্যুষিত জেবেল আমির এলাকাটাকে এখনো এক প্রকার নিষিদ্ধই করে রাখা হয়েছে। অথচ এই এলাকাতেই হলুদ জ্বরের প্রকোপটা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল।

শেষপর্যন্ত হলুদ জ্বরের কার্যকর টিকা আবিস্কার হলেও সংঘাত বা সংঘাত পরবর্তি বিরোধপূর্ণ সমাজে এটি প্রয়োগ বেশ কঠিন। যেটির প্রমাণ মিলেছে দারফুরে। এই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিষেধক প্রক্রিয়া ও প্রশমন ব্যবস্থা সবই জানা থাকবার পরও এমনি রাজনৈতিক সংঘাত রয়েছে এমন দেশগুলোতে স্বাস্থ্যদুর্যোগ মোকাবিলা খুব একটা সহজ হয়ে ওঠে না।

বিশেষ করে যেখানে এই ধরনের সংঘাতে খোদ সরকার নিজে সম্পৃক্ত। এসব দেশে জনসাধারণ কখনোই বিশ্বাস করতে পারে না, সরকার একা এমন স্বাস্থ্যদুর্যোগ সামাল দেয়ার সামর্থ্য রাখে। এমন প্রেক্ষিতে যেটি দরকার তা হচ্ছে, সরকারতো বটেই এর সঙ্গে বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন অরাষ্ট্রিক সংগঠন ও দরকার হলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ।

সংবাদটি শেয়ার করুন