শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বরেন্দ্রে সুপেয় পানি

বরেন্দ্রে-সুপেয়-পানি.

পদ্মার বুকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে সুপেয় পানির সঙ্কট প্রকট হচ্ছে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিতে আয়রন ও আর্সেনিকের উপস্থিতি তো আছেই। এ সমস্যার সমাধানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে খাবার পানির নানা ধরণের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এই এসব প্রকল্প টেকসই হচ্ছে না। এক্ষেত্রে কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট প্লাস (সিএম+) মডেল এ সঙ্কট সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ বদরুল হাসান।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার কক্ষে আয়োজিত ‘কমিউনিটি ভিত্তিক খাবার পানির অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট প্লাস মডেলের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন কালে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ গবেষণা অনুদানের আওতায় পরিচালিত গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে।

এর আগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলে পরিচালিত গবেষণায় ড. মুহাম্মদ বদরুল হাসান এই মডেল উদ্ভাবন করেন। এর মূল কথা হলো সুপেয় পানি নিশ্চিতে শুধু প্রকল্প বাস্তবায়নই শেষ নয়; তা টেকসই করতে হলে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা, কামিউনিটি পর্যায়ে পারস্পারিক সুসম্পর্ক প্রয়োজন। সুপেয় পানির অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও ব্যবহারকারী উভয়ে মিলে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই অবকাঠামোগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন থাকবে। আর এই সমন্বয় সাধনে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রক্রিয়াকেই তিনি সিএম+ মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  উদীয়মান অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় এগিয়ে বাংলাদেশ

উদ্ভাবিত মডেলের বিষয়ে এই পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বলেন, সিএম+ মডেল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে কার্যকরী। কিন্তু দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এই মডেলটি বাস্তবায়ন যোগ্য কিনা— তা যাচাই করতে বরেন্দ্র অঞ্চলে আমরা এই গবেষণা পরিচালনা করি। সেখানেও এ মডেল অনেকাংশে কার্যকরী হবে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমাদের এই গবেষণা ফলাফল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিবেচনা করা হলে বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় পানি নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি। সেইসঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৬নং লক্ষ্য (২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য সুপেয় পানির সরবারহ নিশ্চিত করা) এবং ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নে কার্যকরি ভূমিকা রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ। সেমিনারে বক্তব্য রাখেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইন্টারন্যাশনাল ট্রেইনিং নেটওয়ার্কের পরিচালক (আইটিএন) পরিচালক অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব হোসেন, অধ্যাপক ড. স. ম. আলী রেজাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পানি বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ।

পানি বিশেষজ্ঞ কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, দিনে দিনে হাইড্রো পলিটিকস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আগামীতে পানি সঙ্কট এবং পানি দারিদ্রতা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এক্ষেত্রে গবেষকের উদ্ভাাবিত পানি ব্যবস্থাপনা মডেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি আরও বলেন, এই মডেলে সামষ্টিক প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপশি প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবথধান দরকার। সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে সচেতনতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য পানি না রেখে গেলে তারা আমাদের অভিসম্পাত করবে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, খাবার পানি সঙ্কট নিরসনে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা খুব জরুরি। সেক্ষেত্রে এই গবেষণা কার্যকরি।

আরও পড়ুনঃ  কমেছে গড় ক্রয়মূল্য বিক্রিতেও নিম্নমুখী

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, এই গবেষণা কার্যক্রম প্রথমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পরিচলনা করা হয়েছিলো। কিন্তু সেখানেই সীমাবদ্ধ না থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও বিস্তৃত হওয়ায় গবেষক দলকে ধন্যবাদ। আগামীতে এটা দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিস্তৃত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, এই মডেলে উল্লেখিত সামষ্টিক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে স্থানীয় সরকারকেও যুক্ত করা যেতে পারে। এতে মডেলটি আরও বেশি কার্যকর হবে বলে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান বলেন, যে মডেলটি উদ্ভাবন করেছেন সেটাকে জীবন দিতে হবে। অর্থ্যাৎ বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে এই মডেলটি বইয়ের পাতাতেই থেকে যাবে। সুপেয় পানি নিশ্চিতে এক সময় কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট মডেলের কথা বলা হতো। কিন্তু তা এখন কাজ করছে না। কেন কাজ করতো না- সে বিষয়ে এই মডেলে তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণায়। এটা কার্যকর করার চিন্তা সংশ্লিষ্টদের আছে বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইন্টারন্যাশনাল ট্রেইনিং নেটওয়ার্ক (আইটিএন) পরিচালক অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বলেন, কোনো কিছু হলেই আমরা প্রযুক্তিকে দোষারোপ করি। কিন্তু আসলে আমাদের ব্যবস্থাপনারও অভাব রয়েছে। সেক্ষেত্রে উদ্ভাবিত মডেল গুরুত্বপূর্ণ। এই মডেলের সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত করা যেতে পারে। তাহল কার কতটুকু ভূমিকা তা তুলে আনা। যেমন সরকার, কমিউনিটি, স্থানীয় সরকার, বেসরকারি সংস্থা- সকলের ভূমিকা তুলে আনা।

সমাপনী বক্তব্যে ঢাবি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, আমরা অনেক আনন্দিত যে আমাদেরই একজন শিক্ষক এই ধরণের একটি গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেছেন। এই গবেষণার একটি বিশেষ দিক হলো রাজনীতিকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। তিনি এই উদ্ভাবনকে অন্তর্ভূক্তিমূলক করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।

আরও পড়ুনঃ  সিলেটে চার ঘন্টায় সাতবার ভূমিকম্প

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন