বাবা ভাত খাচ্ছেন। সাথে আমরা অনেকগুলো ভাইবোন, কাজীর দেউড়ির বাসায় ডাইনিংএর বড় টেবিলটাতে একসঙ্গে খাচ্ছি। বাবা খাবার পর একটা বাটিতে জমা করলেন সবার পাতের উচ্ছিষ্ট, মুরগির হাড়, মাছের কাঁটা, কানকো ইত্যাদি। তখন ডাইনিং রুমের দরজার কাছে গার্ড দিচ্ছে টাইগার। খুব লেজ নাড়ছে। আর বাড়ির দু’টো বেড়াল—মেনী আর পুসি—ম্যাঁও ম্যাঁও করে ঠিক টেবিলের নীচেই বসা। খেতে বসা বাচ্চাদের পা ঘেঁষে ঘেঁষে তাদের আবদারের বাক্যনিচয়—ম্যাঁও, ম্যাঁও। বাবা বারান্দার বাইরে একটি পয়:নিষ্কাশনের নালার ওপর জগের পানি ঢেলে হাত-মুখ ধুলেন, কুলি করলেন। তারপর একটা গামছা দিয়ে হাত মুখ মুছে হাড় কাঁটা জমা করা বাটিটা নিয়ে উঠোনে বড় নারিকেল গাছটার তলায় উপুর করে ঢাললেন। টাইগার পরম আনন্দে লেজ নেড়ে নেড়ে সেগুলি সাবাড় করল। পাশের বাড়ির অতিথি কুকুর কালাইয়া এসে জয়েন করতে চাইল, টাইগার দাঁত কেলিয়ে এমন একটা ধমক দিল, কালাইয়া দূরে সরে গেল। মেনী আর পুসির জন্যও বাবা কিছু রেখেছিলেন, সেগুলি তারা উঠোনের আরেক পাশে সাবাড় করল।
এই পারিবারিক স্মৃতিটি আজকে, ২৩শে ডিসেম্বর শুক্রবার আমার মধ্যে দুর্মরভাবে জেগে উঠল কারণ সকালবেলায় আমি এমন একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম যেখানকার আলোচনার বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমার বাবার বাড়ির কুকুর ও বিড়ালের খাবার সংস্থানের একটা সম্পর্ক খুঁজে পাই। দিনব্যাপী এই সেমিনারটির আয়োজন করেছিল ইকো ফাউন্ডেশন নামক একটি নতুন পরিবেশবাদী বেসরকারি সংস্থা। ইকো হচ্ছে এনভাইরনমেন্ট কমিউনিটি এ্যান্ড ওশেন ডেভেলপমেন্ট ফাউনডেশনের সংক্ষিপ্ত নাম। এটার সভাপতি হয়েছেন আমার চবি-র এককালীন সহকর্মী সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগের শ্রদ্ধেয় প্রবীণ অধ্যাপক (এখন অবসরপ্রাপ্ত) ড. ননী গোপাল দাশ। উনার মাথায় কী ঢুকেছিল জানি না। উনি আমাকে দলে টানলেন সহ-সভাপতি হিসেবে। আমিও যোগ দিলাম সমুদ্রের প্রতি আমার অপার কাব্যিক বিস্ময়বোধ আছে বলে। সমুদ্রের প্রসঙ্গ আসলেই জীবনানন্দ দাশের এই চরণটির উদ্ধৃতি করার লোভ আমি কোনদিন সামলাতে পারি না: “সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নিয়া / তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া।” ননীদাও আমাকে বললেন, আপনাকে রেখেছি, কারণ আপনি সমুদ্র আর সাহিত্যের মধ্যে ব্রিজ সুষ্টি করবেন।
সংস্থাটির প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে সুজিৎ দাশ আর তার ছোট ভাই বিশ্বজিৎ দাশ। সুজিৎ চবিতে ননীদার সরাসরি ছাত্র ছিল। মালয়েশিয়ায় চাকরি করে পরিবেশসংক্রান্ত একটি ফার্মে। গত তিন বছর ধরে চেষ্টা চরিত্র করে এরা সংস্থাটি অনেকখানি দাঁড় করিয়েছে। আজকে ছিল বাৎসরিক সাধারণ সভা। ইয়াং ইয়াং অনেক তরুণ সামুদ্রিক বিজ্ঞানী একে একে তাঁদের বক্তব্য রাখতে লাগলেন। তরুণেরা কোন একটা উদ্যম নিলেই আমার খুব ভালো লাগে। এবং বিষয়বস্তুগুলি যেহেতু আমার অধীত জ্ঞানের বাইরে, সম্পূর্ণ অচেনা, সে জন্য আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁদের আলোচনা শুনছিলাম। তখন ময়মনসিংহের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. শ্যামলেন্দ্র বিকাশ দাশের উপস্থাপনায় পেলাম ‘ব্লু ইকোনোমি’ বা নীল অর্থনীতি ফ্রেইজটি।
নীল অর্থনীতি কী? মোটা অর্থে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদই হচ্ছে নীল অর্থনীতির ভিত্তি। আর নামটা নিশ্চয় এসেছে সমুদ্রের পানি যে দেখতে নীল তার থেতে। শ্যামলেন্দ্রের বক্তৃতায় এবং আরো কয়েকজনের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে কিছু তথ্য পেলাম যেগুলি সাধারণভাবে এখানে উল্লেখ করছি।
উত্তরবঙ্গের সাধারণ লোকজন সামুদ্রিক মাছের সঙ্গে পরিচিত নয়, সেজন্য তারা সামুদ্রিক মাছ খায় না, কিংবা খেতে স্বস্তি বোধ করে না। বাংলাদেশের আয়ত্তাধীন সমুদ্রের আয়তন ১৯৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার, এবং এই বিপুল জলরাশির মধ্যে নিমগ্ন হয়ে আছে বিশাল এক জলজ সম্পদ। এই জলজ সম্পদের মধ্যে আছে সামুদ্রিক উদ্ভিদ আর সামুদ্রিক মাছ। কিন্তু নীল অর্থনীতির মূল জোরটা হচ্ছে আমরা যে এই সমুদ্রসম্পদ অকাতরে নষ্ট করছি তারই একটি মর্মন্তুদ বিবরণ। এখানেই আমার বাবার মাছের কাঁটা, মুরগির হাড় নর্দমায় ফেলে না দিয়ে টাইগার আর মেনী-পুসির খাদ্য হিসেবে খরচ করার মধ্যে কোন কিছু যাতে নষ্ট বা ওয়েস্টিজ না হয় সেই সচেতনতার সঙ্গে আজকালের উদ্ভাবিত নীল অর্থনীতির দর্শনের পুরোই মিল।
টেকসই উন্নয়ন বা সাস্টেনেইবল ডেভেলপমেন্ট গ্রৌথ নামক যে চেঁচামেচির তোলপাড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে, নীল অর্থনীতি এটারই অংশ হলেও কিন্তু এটার মতো আনসাউন্ড নয়, বরঞ্চ বেশ একটা গভীর প্রত্যয় ও বাস্তবদর্শনের প্রতিফলন এটা।
সামুদ্রিক মাছ বলতে আমরা চাঁটগাঁইয়ারা যেমন লইট্যা, চিংড়ি আর রূপচান্দা ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝি না, কিংবা ইলিশ, আর শুটিকির মধ্যে লাক্কা, নীল অর্থনীতি বলছে, না শুধু এই মাছগুলি নয় সামুদ্রিক যে কোন মাছ –যেমন কোরাল, টুনা, ম্যাকারেল, স্যামন সহ আরো বহু মাছ আছে যেগুলি খাওয়া যায়। কিন্তু নীল অর্থনীতি এইগুলির কথাও বলছেনা, কারণ এইসব মাছ খানিকটা অপরিচিত হলেও কমবেশি বাংলাদেশীরা খায়। নীল অর্থনীতি বলছে সে মাছগুলির কথা যেগুলি আমরা খাই না, অথচ খাওয়া যায়, কিংবা যেগুলি রপ্তানী করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে। যেমন জেলী ফিশ বা এই প্রকারের সকল মাছ নাকি জালে ধরা পড়লেই জেলেরা বাতুল মাছ হিসেবে ফেলে দেয়, কারণ তারা এগুলির ব্যবসা-সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন নয়। অথচ জেলী ফিশ এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের কোন কোন দেশে বিরাট ডেলিকাটিসিন। কাঁকড়া বেশ কয়েক বছর ধরে জাতে উঠেছে, এবং অভিজাত চায়নিজ রেস্তোরাঁয় একটা ডিশ থাকেই। তবে কাঁকড়া প্রজাতির বহুরকম কাঁকড়া আছে যেগুলির রপ্তানি মূল্য প্রচুর। কচ্ছপ, টার্টল, এমন কি শুশুক, হাঙর, ইত্যাদিরও নাকি বহু প্রজাতি আছে, এবং সবগুলির রপ্তানী সম্ভাবনা প্রচুর। সামুদ্রিক শসা নামক একটি মাছ, যেটি আমি কোনদিন দেখিনি, এটিও নাকি জেলেরা ফেলে দেয় বা মেরে ফেলে এটির কোন ব্যবহার না জেনে। বিভিন্ন বক্তা তাঁদের বক্তব্যে এই ধরনের সম্ভাবনাময় এমন বিশাল একটি ছবি আঁকলেন যে আমার আজকেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে সমুদ্রে এই মাছের রাজত্ব দেখতে।
বস্তুত সেমিনারটি ছিল নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা সম্পর্কে উপস্থিত শ্রোতৃমন্ডলিকে অবহিত করা, এবং প্রকারান্তরে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সচেতন করানো।
তাঁদের কথায় বুঝলাম যে এই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সমুদ্র-সম্পদ আহরণ ও তার থেকে অর্থায়িত করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে।
আমি ননীদা সহ সকলকে এত তথ্যবহুল একটি সেমিনারের আয়োজন করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এবং ইকো ফাউন্ডেশনের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
লেখক: অধ্যাপক ড. মোহিত উল আলম, সাবেক উপাচার্য- জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল-ময়মনসিংহ