ঢাকা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের (ডিইপিজেড) কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ৭৫ শতাংশ নারীশ্রমিক মানসিক ও মৌখিকভাবে হয়রানির শিকার হন। আর এসব হয়রানির ঘটনার শতকরা ৮০ ভাগই ঘটে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সুপারভাইজার আর লাইন ম্যানেজার দ্বারা। এসব তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি সংস্থা ‘কর্মজীবী নারী’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে। গবেষণায় শতকরা ২২ ভাগ নারীশ্রমিকের বক্তব্য হচ্ছে, তাদের কারখনায় হয়রানিবিরোধী কমিটি থাকলেও কোনো হয়রানি ঘটনায় সেই কমিটিকে তত্ত্বাবধায়ন করতে তারা দেখেননি।
গবেষণাটি করা হয়েছে, ডিইপিজেড এলাকার নারীশ্রমিকদের বাসস্থান সাভারের আশুলিয়ার ভাদাইল এবং শ্রীপুর গ্রামের ৩০০ জন নারীশ্রমিককে নিয়ে। গত বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয় গবেষণার কাজ। শেষ হয় চলতি বছরের জুন মাসে। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিইপিজেড সাভারের আশুলিয়া ধামসোনা ইউনিয়নের ভাদাইল গ্রামে অবস্থিত। বর্তমানে সেখানে ৫ লাখ ১৬ হাজার ৫৮৮ জন শ্রমিক কর্মরত। যার মধ্যে ৬৬ শতাংশই নারীশ্রমিক।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, যে কোনো ধরনের হয়রানি শিকার হলে শতকরা ৫৭ ভাগ নারীশ্রমিকই বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) অথবা সংশ্লিষ্ট কারখানায় অভিযোগ করতে ভয় পায়। একই সঙ্গে শতকরা ৩২ ভাগ নারীশ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার হলেও কোনো ধরনের অভিযোগ না করে বরং নীরবতাকেই শ্রেয় মনে করেন।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর ডেইলি স্টার সেন্টারে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ডায়লগে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কর্মজীবী নারী’র গবেষণা অফিসার ফারহানা জোবাইদা ঊর্মি। ‘ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শ্রমিকদের অধিকার: বর্তমান পরিস্থিতি এবং উদ্যোগের উপর জাতীয় সংলাপ’ বিষয়ক সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তার। বিশেষ অতিথি ছিলেন মেডিকেল অ্যান্ড লেবার ওয়েলফেয়ার সেকশন ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের পরিচালক ড. আলপনা সরকার। অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন কর্মজীবী নারী’র ভাইস প্রেসিডেন্ট উম্মে হাসান ঝলমল।
গবেষণা প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারীশ্রমিকের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। যেখানে ওই নারী বলেন, আমাদের কারখানায় কোনো বিচার নেই। যৌনহয়রানি প্রতিরোধে কমিটি মালিকের পক্ষে কাজ করে। যিনি অভিযোগ করেন তাকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে কারখানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে আরেক নারীশ্রমিক তার বক্তব্যে বলেছেন, কাজ করার সময় তার লাইনের সুপারভাইজার তার হাত ধরে অশালীন মন্তব্য করার পরেও চাকরি হারানোর ভয়ে তিনি এর প্রতিবাদ করতে পারেন নি।
গবেষণার ফলাফল বিষয়ে কর্মজীবী নারী’র ভাইস প্রেসিডেন্ট উম্মে হাসান ঝলমল বলেন, নারীশ্রমিকদের হয়রানির ৮০ ভাগ ঘটনাই ঘটে যারা তাদের দেখাশোনার জন্য থাকেন তাদের দ্বারা। এখন শ্রমিকদের ডাটাবেজ ডিজিলালাইজ হওয়ার পরে একটি অসুবিধা হয়েছে। কাউকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার পর তাদের আইডি নাম্বার সব কিছু অনলাইনের দিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে অন্য প্রতিষ্ঠানেও নতুন করে তাকে আর চাকরিতে নিতে চায় না। উম্মে হাসান ঝলমল বলেন, একজন সুস্থ শ্রমিক সুস্থ উৎপাদন দিতে পারে। সেজন্য নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
মেডিকেল অ্যান্ড লেবার ওয়েলফেয়ার সেকশন ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের পরিচালক ড. আলপনা সরকার বলেন, ইপিজেড এ এক ধরনের শ্রমআইন ও ইপিজেড এলাকার বাইরে আরেক ধরনের শ্রমআইন থাকতে পারে না। একই দেশে দুই শ্রম আইন থাকা উচিত নয়।
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তার এমপি বলেন, শ্রম অধিকার রক্ষায় নারী শ্রমিকসহ সকল শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোকে মাঠের আন্দোলন শক্তিশালী করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইপিজেড নিয়ে কথা বলতে হবে। ইপিজেড এর বায়ারদের সঙ্গে শ্রমিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। গার্মেন্টস ও ইপিজেডসহ সব শ্রমখাতকে একসঙ্গে করে সুপারিশমালা তৈরি করা যেতে পারে।
নারীশ্রমিকদের সুপারিশ: সব কারখানায় কার্যকর ও পক্ষপাতবিহীন এন্টি-হ্যারেসমেন্ট কমিটি গঠন করতে হবে। কারখানার বিভিন্ন কমিটিকে (যেমন শ্রমিক কল্যাণ সমিতি, এন্টি-হ্যারেসমেন্ট কমিটি, সেফটি কমিটি, পার্টিসিপেশন কমিটি) নূন্যতম তিন মাস পরপর শ্রমিকদের সাথে সাধারণ সভা করতে হবে। অভিযোগ বক্সে জমা পড়া অভিযোগসমূহের সটিক বিচার করতে হবে। বেপজা বর্তমানে চট্টগ্রাম ইপিজেড, ঢাকা ইপিজেড, মোংলা ইপিজেড, ঈশ্বরদী ইপিজেড, কুমিল্লা ইপিজেড, উত্তরা ইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড এবং আদমজী ইপিজেডসহ ৮টি অপারেশনাল এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) তত্ত্বাবধান করছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অন্যতম সম্পদ শ্রমশক্তি। যার ওপর ভর করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে এগিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে স্থান করে নেবে। তবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে আসীন হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো অনেকটা উন্নতির প্রয়োজন। তার মধ্যে শ্রম আইনের যথাযথ প্রয়োগ, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, মজুরিবৈষম্য, সময়মতো মজুরি প্রাপ্তি, চাকরির অনিশ্চয়তা অন্যতম। আর এ থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হলো আইএলও সনদ-১৯০ অনুস্বাক্ষর ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা।
বাংলাদেশে হয়রানি ও সহিংসতা রোধে অনেকগুলো বিশেষ আইন করা হয়েছে। তবে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সহিংসতা রোধে আইনি কাঠামো তুলনামূলকভাবে এখনো দুর্বল। বাংলাদেশের শ্রম আইনে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সহিংসতাকে সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। শ্রম আইনের ৩৩২ ধারায় নারীর প্রতি ‘অশ্লীল ও অভদ্রজনিত’ আচরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা জেন্ডার সংবেদনশীল নয়। ধারাটি নারীর প্রতি কর্মক্ষেত্রে ঘটা নানা ধরনের হয়রানি ও সহিংসতাকে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে না। এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির পরিমাণ মাত্র ২৫ হাজার টাকা।
এ–সংক্রান্ত ২০০৯–এর নীতিমালায় শুধু যৌন হয়রানি সংজ্ঞায়ন করা হচ্ছে। অথচ আইএলও সনদ ১৯০ অনুযায়ী জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও হয়রানিকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। ২০০৯–এর নীতিমালায় যিনি হয়রানি করছেন, তার শাস্তির বিষয়টি আছে। কিন্তু যিনি হয়রানির শিকার হলেন, তার জন্য কাউন্সেলিং ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। এ ছাড়া জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও শ্রম আইনের প্রয়োগের কাঠামো অনেক দুর্বল। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধন করা দরকার। ২০০৯–এর নীতিমালা প্রয়োগ ও তদারকি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আনন্দবাজার/শহক