আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। উপকূলবাসীর কাছে এটি এক দুঃসহ স্মৃতির দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলের জনপদ, জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন। নিঃস্ব হয়ে পড়েন হাজারো পরিবার। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে ছিল চট্টগ্রামের বাঁশখালী, যেখানে প্রাণহানি হয় প্রায় ৩০ হাজার মানুষের।
ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার, সঙ্গে ছিল প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। এতে ডুবে যায় ফসলের মাঠ, ভেসে যায় লাখ লাখ গবাদিপশু। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, চকরিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া এলাকা।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হালিশহর, আগ্রাবাদ, কাটঘর, বন্দর ও পতেঙ্গা এলাকাও তছনছ হয়ে যায়। বন্দর থেকে ছিটকে যায় নোঙর করা জাহাজ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নৌবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায়। ভেসে যায় নৌ ও বিমানবাহিনীর অবকাঠামো, ক্ষতিগ্রস্ত হয় উড়োজাহাজ। জলোচ্ছ্বাসে অনেক সদস্য পরিবারসহ আটকা পড়েন, হারিয়ে ফেলেন প্রিয়জনকে।
সেদিন রাত ১০টার পর হঠাৎই ১০ থেকে ২৫ ফুট উচ্চতার সাগরের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এক রাতেই অসংখ্য মানুষ হারায় পরিবারের সদস্যদের। কেউ সন্তান, কেউ স্ত্রী, কেউ বা ভাই-বোন হারিয়ে শোকের সাগরে ভাসে।
৩৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রাতের বিভীষিকা ভুলতে পারেন না উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই আজও আতঙ্কে কেঁপে ওঠে বুক। সেই রাতে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি, কেউ কেউ তথ্যও পাননি। সেসময় আবহাওয়া বিভাগ ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করলেও সচেতনতার অভাবে অনেকে রয়ে যান নিজ ঘরে।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে পঁচানব্বই বছর বয়সী ফজল আহমদ বলেন, ‘সেসময় আমার বয়স ৫০ পেরিয়েছে। আমি বলী ধরতাম, শক্তিশালী ছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের সময় গাছের ওপর উঠে ছিলাম। নিচে দেখছি বিভিন্ন বয়সের মানুষের মরদেহ ভেসে যাচ্ছে। একজনকে দেখলাম তার ছোটো শিশুকে একটা থলের মধ্যে ভরে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় এই বৃদ্ধের।
এদিকে বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি বিষয়ে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমাদের সিপিপি সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাছাড়া ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে আগাম সতর্ক করা ও আশ্রয়ণকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেড়িবাঁধের অরক্ষিত অংশের কাজ শুরু হয়েছে। যেসব স্থানে এখনো কাজ শুরু হয়নি সেখানে আপাতত জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
তিনি জানান, এখন প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে আবহাওয়ার আগাম সংবাদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়েছে।
আজকের দিনটি স্মরণে উপকূলীয় অঞ্চলে অনেকেই পরিবারের হারানো সদস্যদের জন্য দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন।