দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকটে নিমজ্জিত থাকলেও সরকারের নীতিগত সমর্থনের কারণে দেশের অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি এভিয়েশন খাতেও প্রবৃদ্ধি দিন দিন বাড়ছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মাহবুব আলীর প্রত্যাশা আগামী ১৫ বছরে দেশের এভিয়েশন খাতে প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় ৩ গুণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশের সব বিমানবন্দরে রাডার স্থাপনসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। বিদ্যমান দু’টি এয়ারলাইন্সের দিন-দিন রুট সংখ্যাও বাড়ছে। সম্প্রতি যাত্রা শুরু করেছেন নতুন এই এয়ারলাইন্স এয়ার অ্যাস্ট্রা। যে সংস্থা ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার অঙ্গীকার করেছে। এছাড়া বর্তমানে দেশের সব অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তথ্যমতে, সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর করে তুলতে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করতে চলছে উন্নয়ন কার্যক্রম। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজও চলমান। এখন দরকার এসব বিমানবন্দরে কাজ করার জন্য দক্ষজনবল তৈরি।
এভিয়েশন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংকট যেমন রয়েছে পাশাপাশি সম্ভাবনার নতুন দুয়ারও খুলে গেছে। সম্প্রতি অ্যাভিয়েশন খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশকে এভিয়েশন হাব করতে প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনবলের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এজন্য নীতিগত প্রতিকূলতাগুলো দূর করতে হবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি এয়ারলাইনবান্ধব নীতি হলেই এভিয়েশন খাত দ্রুত এগিয়ে যাবে। একই সঙ্গে পর্যটন ও অর্থনীতিতে গতি বাড়বে। গতকাল বুধবার সারাবিশ্বেই নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশন দিবস পালন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘গ্লোবাল এভিয়েশন ডেভেলপমেন্টের জন্য অগ্রসরমান উদ্ভাবন’। বিশ্বজুড়ে পালন করা হলেও এখনও বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয় না।
দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশে এভিয়েশন খাতের ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অনেকটাই সম্পৃক্ত। একাত্তরে বিজয় লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন শিল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করনে। সে সময় রাষ্ট্রপতির গ্রহণ করা ১২৬ নং অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিভিল এভিয়েশন অথরিটি গঠিত হয়।
এভিয়েশন শিল্পের উন্নয়নে জাতির পিতা বড় উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে সেই খাতকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর সেই ধারাবাহিকতারই অংশ হিসেবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনাল, ১০টি হ্যাংগার নির্মাণ, রানওয়ে শক্তিশালীকরণ, কক্সবাজার বিমানবন্দরে সমুদ্রে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিসহ দেশের সব বিমানবন্দরের উন্নয়ন করা হচ্ছে।
তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অ্যাভিয়েশন খাত। সারা বিশ্বে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি এবং বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা আলাদাভাবে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ সেই নীতি অনুসরণ করছে না। ১৯৮১ সালে সিভিল অ্যাভিয়েশন অধিদফতর এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দুটো আলাদা সংস্থাকে একীভূত করে একটি সংস্থা করা হয়। বর্তমানে ফের সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি থেকে বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা পৃথক করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে অ্যাভিয়েশন খাতে সবচেয়ে বড় সংকট দক্ষ জনবলের। দেশি এয়ারলাইনগুলোকে এখনও বিদেশি পাইলট, প্রকৌশলীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশি ৪টি এয়ারলাইন যাত্রী পরিবহন করছে। এসব এয়ারলাইনে যে পরিমাণ পাইলট প্রয়োজন, তা দেশে না থাকায় কাজ করছেন বিদেশি পাইলটরা। পাইলট তৈরির জন্য নেই সরকারি কোনও উদ্যোগ। দেশে বর্তমানে পাইলট প্রশিক্ষণ একাডেমি ৩টি। এরমধ্যে আরিরাং ফ্লাইং স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি, গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমির কার্যক্রমও সীমিত পরিসরে।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, দেশের পাইলট ট্রেনিং একাডেমিগুলো উড়োজাহাজ ও প্রশিক্ষক সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সংকটের মধ্যে রয়েছে। ব্যয় বেশি হওয়ায় ফ্লাইং একাডেমিগুলোতে পড়তে প্রতিষ্ঠানভেদে ৩০-৩৫ লাখা টাকা খরচ হয়। ফলে চাহিদার বিপরীতে সীমিত সংখ্যক পাইলট প্রস্তুত হচ্ছে দেশে। দেশে পাইলট ট্রেনিং একাডেমিতে প্রশিক্ষণ জটিলতাসহ নানা সমস্যা দূর না করা গেলে এ সংকট আরও বাড়বে। ফলে উচ্চ ব্যয়ে বিদেশি পাইলটের ওপর নির্ভর হয়ে পড়বে দেশের এয়ারলাইনগুলো।
সমস্যা আরও রয়েছে। মূলত, এয়ারলাইনের পরিচালনা ব্যয়ের ৪০-৪৬ ভাগই জ্বালানি খরচের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি। জ্বালানি তেলের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশি এয়ারলাইনগুলোকে। বাংলাদেশি এয়ারলাইনগুলোকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি মূল্যে তেল ক্রয় করতে হয়। বেসরকারি এয়ারলাইনগুলোর মালিকেরা দীর্ঘদিন ধরে এ সংকট মোকাবিলায় সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে।
বেসরকারি বিমান সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, অ্যাভিয়েশন খাতে জনবলের চাহিদা বেড়েছে। যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন সে অনুপাতে দক্ষ লোক নেই। জনবল সৃষ্টি না হলে বিদেশি কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইলট প্রশিক্ষণসহ এয়ারলাইনগুলোর চাহিদা অনুযায়ী জনবল প্রশিক্ষণ দিলে এ খাত এগিয়ে যাবে।
আনন্দবাজার/শহক