ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুসংবাদ নেই ডলারে

সুসংবাদ নেই ডলারে

করোনা মহামারি কাটিয়ে ওঠার শুরুতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। টালমাটাল হয়ে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি। যার ফলে বিশ্ববাজারে বেড়ে যায় প্রায় সব ধরণের পণ্যের দাম। যে কারণে পণ্য কিনতে বিগত সময়ের তুলনায় বাড়তি ডলার খরচ করতে হয় বাংলাদেশকে। তবে সেই তুলনায় বাড়েনি রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। বরং ধারাবাহিকভাবে কমছে রেমিট্যান্স। এরই মধ্যে ভাটা পড়েছে রপ্তানি আয়েও। যে কারণে বেড়েছে ডলার সংকট। বাজারের অস্থিরতা কমাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থপাচার আর অতি প্রয়েজনীয় নয় এমন পন্য আমদানী করার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যে কারণে ডলার সংকট বাড়ছে। এছাড়াও অনেকে আবার দাম বাড়ার আশায় ডলার মজুত করছে।

বর্তমানে জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারের অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কেবল ডলার দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার পাচ্ছে না। ডলারের উচ্চ দাম ও সংকটের কারণে চাপে পড়েছে মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরা। ডলারের খরচ বাড়ায় অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসার পরিধি কমিয়ে ফেলছেন। আবার চাইলে অনেকে চাহিদামতো আমদানি ঋণপত্রও খুলতে পারছেন না। ঋণপত্র খুলতে না পেরে সংকটে পড়েছেন তারা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম চার মাস (জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর) রিজার্ভ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে দিন দিন রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত বছর একই সময়ে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে গত বছরের আগস্ট মাসে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।

এদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বা রিজার্ভের বড় দুই উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয় টানা দুই মাস ধরে কমছে। এতে ডলার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সবশেষ হিসেব অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) অথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে রপ্তানি আয় গত বছর একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরেও কমেছে রপ্তানি আয়। এর আগে টানা ১৩ মাস রপ্তানি আয় বেড়েছিল।

ডলার সংকটে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। শুধু যাদের রপ্তানি আয় আছে ও বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংক শুধু তাদের ঋণপত্রই খুলছে বলে অভিযোগ। আমদানি দায় কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারি ঋণপত্রের দেনা মেটাতে নিয়মিতভাবে ডলার বিক্রিও করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২২ সালের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়। অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। শুধু সরকারি এলসির দায় মেটাতে এখন ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা এবং রপ্তানি বিল নগদায়নে ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা দর দিচ্ছে।

এদিকে, নানা পদক্ষেপের পরও আমদানির চেয়ে রপ্তানি অনেক কম হওয়ায় এই তিন মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, বাজারে ডলার নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশি মুদ্রার মান ধরে রাখতে ডলার বিক্রি করছে। তবে রিজার্ভ কিন্তু দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাদের যতদিন সক্ষমতা থাকবে ততদিন বিক্রি করবে। আমাদের ডলারের প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিট্যান্স আর রপ্তানি আয়। এগুলো কমছে।

এছাড়া অতি ধনী লোকরা বিদেশে কার মার্কেটের মাধ্যমে ডলার নিয়ে নিচ্ছে। এদেশ থেকেও পাচার হচ্ছে। দেখা গেলো অনেকেই ঠিকাদারি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। তারাই তো এদেশ থেকে টাকা পাচার করছে। আবার ধরেন অনেকে বিদেশ গিয়ে অর্থ নিয়ে নিচ্ছে। আর বাংলাদেশে তাদের পরিবারকে বাংলাদেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে। এখানে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আসলো না।

অনেকে ডলার মজুত করছে মন্তব্য করে আবু আহমেদ বলেন, তারা মনে করছে ডলার মজুত করলেই দাম বাড়বে। আগেও কিন্তু আমাদের সবকিছুই আমদানি করতে হতো। কিন্তু এখন কেন সংকট। এই লোক লোকগুলো কোথাও যাচ্ছে না। কিন্তু মজুত করে রাখছে। ডলার হলো গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি। বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য অনেকেই ডলার পাচার করছে। আবার অনেকে মজুত করছে। সব মিলিয়ে ডলার সংকট হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ডলার সংকট কাটাতে হলে অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে হুন্ডি ঠেকাতে হবে। হুন্ডি, আমদানি-রপ্তানিতে দর বেশি বা কম দেখানো, রপ্তানির অর্থ যথাযথভাবে ফেরত না আনাসহ বিভিন্ন উপায়ে বছরে দেড় লাখ কোটি টাকার মতো পাচার হচ্ছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার বন্ধ হলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেড়ে এমনিতেই রিজার্ভ ও ডলার বাজার স্থিতিশীল হবে। এছাড়া যত ব্যবস্থাই নেওয়া হোক, ডলার সংকট কাটানো যাবে না।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন