শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাদ্যসংকটে সুবাতাস

খাদ্যসংকটে সুবাতাস

“তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলছেন এবার শস্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকার পাবে দুর্ভিক্ষের শঙ্কায় থাকা আফ্রিকার সোমালিয়া, জিবুতি ও সুদানের মতো দেশগুলো”

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে চেয়েও পরে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিল রাশিয়া। আর তাতেই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনা শঙ্কা শুরু হয়। এমনিতেই বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের কারণে দেশে দেশে দুর্ভিক্ষের সতর্কতা জারি করে যাচ্ছিল জাতিসংঘ। তার মধ্যে পৃথিবীর রুটির ঝুড়িখ্যাত যুদ্ধরত ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির সিদ্ধান্ত ছিল আশার আলো। তবে হঠাৎ করেই সেই চুক্তি করা থেকে রাশিয়া সরে আসার জন্য সেই আলো যেন দপ করে নিভে যায়। বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয়। অবশ্য চারদিনের মাথায় রাশিয়া কঠোর অবস্থান থেকে সরে চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দিয়েছে।

রাশিয়ার এই ঘোষণার পরই বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটে সুবাতাস দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বৈশ্বিক বাজারে গম-ভুট্টা, সরিষা, সয়াবিনের দামে প্রভাব পড়েছে। ব্যাপকহারে কমে গেছে খাদ্যশস্যের দাম। এমন ঘোষণার পর নতুন করে সুবাতাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যশস্যের আমদানির ক্ষেত্রে যে দুশ্চিন্তা ভর করেছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ খাদ্যশস্যের প্রয়োজনীয় আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

“বিশ্বে খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। বৈশ্বিক গম রপ্তানির ৩০ শতাংশের পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে তারা। কমপক্ষে ২৬টি দেশ তাদের অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যশস্যের জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল”

অবশ্য বিশ্বজুড়ে খাদ্যশসের যোগান ঠিক রাখতে রাশিয়া আর ইউক্রেনের বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান রাশিয়া-ইউক্রেনের খাদ্যশস্য চুক্তি অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি গত ৩১ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে এক অনুষ্ঠানে এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন।

মূলত, বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ সহজ করার উদ্দেশে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যে চুক্তির আওতায় তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের বন্দর দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে খাদ্যদ্রব্য রপ্তানির সুযোগ পায় ইউক্রেনে। তবে রাশিয়ার কারণে সেই চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বে খাদ্যশস্য সরবরাহ নিশ্চিতের পথে বড় আঘাত হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। যে কারণে তুরস্ক সেই চুক্তি অব্যাহত রাখার পক্ষে কঠোর অবস্থান জানিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনঃ  বিশ্ববাজারে বাড়ছে গোলমরিচের দাম

তবে এক্ষেত্রে ইউক্রেনের দিক থেকে খাদ্যশস্য করিডোর নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে জাতিসংঘের ‘গ্যারান্টি’ চেয়ে বসে রাশিয়া। ফলে রপ্তানি চালু রাখতে খানিকটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। তবে চারদিনের মাথায় রাশিয়া খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দেয়। গতকাল বুধবার থেকে চুক্তিতে ফিরেছে তারা।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের জন্য কৃষ্ণ সাগরের শস্য করিডোর ব্যবহার করা হবে না বলে কিয়েভের কাছ থেকে লিখিত নিশ্চয়তা পেয়েছে মস্কো। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রুশ ফেডারেশন মনে করছে এই মুহূর্তে প্রাপ্ত নিশ্চয়তা যথেষ্ট এবং চুক্তির বাস্তবায়ন পুনরায় শুরু করছে।

এর আগে গত ২৯ অক্টোবর অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের বৃহত্তম বন্দরনগরী সেভাস্তোপলের কাছে কৃষ্ণ সাগরে রুশ নৌবহরে ইউক্রেনের ড্রোন হামলার অভিযোগে খাদ্যশস্য চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয় মস্কো। ওই দিন এক বিবৃতি দিয়ে মস্কো ইউক্রেনের বন্দর থেকে কৃষি পণ্য রপ্তানির চুক্তি বাস্তবায়‌নে রাশিয়ার অংশগ্রহণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানায়।

আর রাশিয়ার ওই চুক্তি স্থগিতের পর বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট বৃদ্ধির হুমকি তৈরি হয়। যদিও রাশিয়া চুক্তি স্থগিতের পরও কৃষ্ণ সাগরের ইউক্রেনীয় বন্দর থেকে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজের চলাচল অব্যাহত ছিল। তবে রাশিয়ার ওই পদক্ষেপের কারণে ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো নতুন করে চুক্তি না করায় জাহাজ পরিবহন দীর্ঘসময় অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভাষ্যমতে, রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে তুরস্ক এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হওয়া গত ২২ জুলাইয়ের খাদ্যশস্য চুক্তিতে রাশিয়ার পুনরায় ফেরার কথা জানান। আর তার পর থেকেই জটিলতা কাটতে শুরু করে। রাশিয়ার সম্মতি অনুযায়ী বুধবার দুপুর ১২টার আগেই শস্য পরিবহন শুরু হয়েছে। আর সেই ঘোষণার পরই বিশ্ববাজারে নামতে শুরু করে গম, সয়াবিন, ভুট্টা, সরিষাসহ খাদ্যশস্যের দাম। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরও বলছেন, এবার শস্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকার পাবে দুর্ভিক্ষের শঙ্কায় থাকা আফ্রিকার দেশগুলো। এর মধ্যে রয়েছে সোমালিয়া, জিবুতি ও সুদানের মতো দেশ।

আরও পড়ুনঃ  বিলাসি পণ্যে আরও কঠিন শর্ত

মূলত, খাদ্যশস্য রপ্তানি চুক্তির আওতায় ইতোমধ্যে ৯০ লাখ টনেরও বেশি ইউক্রেনীয় শস্য রপ্তানি করার অনুমোদন হয়। আসছে ১৯ নভেম্বর চুক্তিটি নবায়ন করার কথা আছে। যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে কার্যত বন্ধ ছিল কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো। শুধু ওডেসা বন্দরেই আটকা পড়ে ২৫ মিলিয়ন টন শস্য। চুক্তি সইয়ের ফলে রাশিয়ার খাদ্যপণ্যসহ সারও রপ্তানি শুরু হয় এই সমুদ্রপথে।

তাছাড়া বিশ্বে খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। বৈশ্বিক গম রপ্তানির ৩০ শতাংশের পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে তারা। কমপক্ষে ২৬টি দেশ তাদের অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যশস্যের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল।

তবে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর মস্কোর বিরুদ্ধে একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। আর তাতেই গমসহ বিভিন্ন শস্য ও খাবারের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কয়েক মাস আগে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয় রাশিয়া। সেই সঙ্গে বাড়তি উৎপাদিত শস্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি করার সিদ্ধান্তও নেয়। এতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট কমে আসবে বলেও তারা জানিয়েছিল।

যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পরেই রাশিয়ার কৃষিমন্ত্রী দিমিত্রি পাত্রুশেভ শস্য সম্মেলন আহ্বান করে। যেখানে তিনি জানিয়েছিলেন ২০২১–২২ মৌসুমে তারা ২ কোটি ৮৫ লাখ টন গম রপ্তানি করেছে। পরবর্তীতে তা ৩ কোটি ৭০ লাখ টনে উন্নীত করে। গত জুলাই থেকে তারা পর্যায়ক্রমে বিশ্ববাজারে ৫ কোটি টন শস্য রপ্তানি করার অঙ্গীকার করে।

আরও পড়ুনঃ  গণপরিবহন চললে ট্রেনও চলবে: রেলপথমন্ত্রী

এদিকে, বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে জাতিসংঘ বরাবরই সতর্ক করে আসছে। সেই সঙ্গে সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গত কয়েক মাস ধরেই উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে তিনি রাশিয়ার খাদ্য শস্যের চালান সুবিধাসহ ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক খাদ্য সংকট দূর করতে জাতিসংঘ, ইউক্রেন, রাশিয়া ও তুরস্কের স্বাক্ষরিত কৃষ্ণ সাগর চুক্তির আওতায় ৯০ লাখ টনেরও বেশি ইউক্রেনের খাদ্য শস্য রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। তবে চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চললেও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা থেকেই গেছে। আবার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে মস্কো তাদের উৎপাদিত সার বিক্রি করতে পারছে না বলেও অভিযোগ করে রাশিয়া।

জাতিসংঘের তথ্যতমে, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে গত কয়েক বছরে বিশ্বে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। বছর পাঁচেক আগেও পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৮ কোটি মানুষের ঠিকমতো খাবার জুটত না। তবে সেই সংখ্যা কমিয়ে আনার উদ্যোগ সফল হয়নি। তাই সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৫ কোটি।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ইউক্রেন বিশ্বের ৪০ কোটি মানুষের খাদ্য জোগায়, অথচ যুদ্ধের কারণে সেখান থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি প্রায় পুরোটাই বন্ধ হয়ে যায়। রাশিয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম সার রপ্তানিকারী এবং অন্যতম বড় শস্য উৎপাদক, কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞার জেরে বিশ্ববাজারে তাদের পণ্যও ঠিকমতো আসছিল না। সার রপ্তানিতে বৃহত্তম উৎপাদক চীনও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। ফলে অন্যান্য দেশে শস্য উৎপাদন মার খাচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ারসহ বিশ্বের বহু দেশে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় খাদ্যশস্য উৎপাদন ও রপ্তানির দরজা খোলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন