শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ইতিহাস ঐতিহ্য---

দীপাবলি উৎসব

দীপাবলি উৎসব

কার্তিক মাসের অমাবশ্যা তিথিতে দ্বীপান্বিতা কালীপূজা। আজ ২৪ অক্টোবর মধ্যরাতে এ পূজা অনুষ্ঠিত হবে। কালীপূজাকে শ্যামাপূজাও বলা হয়। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দশ মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা মা কালী। তাঁর ভৈরব মহাকাল। কৃষ্ণবর্ণা, ভাস্করি, করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, লোলজিহ্বা, রক্তাক্ত মুন্ডমালা গলে বিলম্বিত, বিবসনা, ত্রিনয়না বিকট দর্শন। আমরা জানি, জগতে সবকিছু সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়। তেমনি মা কালীর উৎপত্তিও হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে।

কালিকা পুরাণ মতে, পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবীজুড়ে ভয়ঙ্কর ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। তারা তাদের আক্রমণের পরিধি পৃথিবীকে অতিক্রম করে দেবলোকে পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। ফলে যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হয়ে দেবলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হন। দেবলোক ফিরে পেতে দেবতারা ভগবান বিষ্ণু, মহাদেব এবং ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে তাঁদের সম্মিলিত উপদেশ ও পরামর্শে দেবতারা আদ্যাশক্তি মহামায়ার আরাধনা শুরু করেন। এতে দেবী মহামায়া সন্তুষ্ট হয়ে দেবতাদের অভয় প্রদান করে অসুর নিধনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। দেবী চন্ডী তথা মহামায়া পার্বতীর শরীর-কোষ থেকে কৌশিকী দেবীর সৃষ্টি হলে দেবী মহামায়া তথা দুর্গা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন এবং কালী বা কালিকা নামে পরিচিতি পান।

ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী কালীপূজার উৎপত্তি বাংলায়। নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি গড়ে কালীপূজার প্রবর্তন করেন। তাঁর লেখা ‘তন্ত্রসার’ নামক গ্রন্থে কালীপুজার বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা আছে। তিনি ছিলেন মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩ খৃষ্টাব্দ) সমসাময়িক। কিন্তু কালীপূজাকে বাংলায় জনপ্রিয় করে তোলেন, আঠারো শতকে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২ খৃষ্টাব্দ)। এরপর ঊনিশ শতকে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু নবজাগরণের সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র এবং বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্টপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপকহারে জনপ্রিয়তা পায়।

আরও পড়ুনঃ  আবারও ফিরেছে বাঘ

মা কালী এমন এক দেবী যিনি বাঙালির চিন্তা-চেতনায়, স্মরণে-মননে নিবিড়ভাবে মিশে রয়েছেন। তাই বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালি হিন্দু রয়েছে সেখানেই কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু বাঙালি হিন্দু নয়, অনেক অহিন্দুও ভক্তি সহকারে কালীপূজা করেন। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মালদার শেফালী বেওয়ার কথা বলা যায়। বিগত ৪০ বছর ধরে তিনি কালীপূজা করে আসছেন। যার সচিত্র প্রতিবেদন গুরুত্বসহকারে প্রতিবছর প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।

বাংলার কাব্য-সাহিত্য-সংগীতে মা কালীর বিস্তর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মা কালীকে ঘরের মেয়ে ভেবে অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব মন পাগল করা গান রচনা করেছেন। যাদের মধ্যে সাধক রামপ্রসাদ, সাধক বামাক্ষ্যাপা, সাধক কমলাকান্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, গিরীষ ঘোষ, সাধক ভবা পাগলা প্রমুখরা অন্যতম। অনেক গায়ক-গায়িকা তাঁদের কণ্ঠে এসব গান ধারণ করে গানগুলোকে অমর করে রেখেছেন।

কাল অর্থ অনন্ত সময়। জগতের উৎপত্তি, স্থিতি, মহাপ্রলয়ের পিছনে রয়েছে কালশক্তি। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, কাল সর্বজীবকে গ্রাস করে। সেই কাল-কে যিনি গ্রাস করেন, তিনিই কালী। এ কালই মহাকাল অর্থাৎ দেবাদিদেব বা শিব। এ কাল-এর অর্থে সংহার ও মৃত্যুর ভাবনাও লুকিয়ে আছে। তাই মা কালী যেমন সময়ের জন্মদাত্রী ও পালনকত্রী তেমনি তিনি প্রলয়কারিণী নিয়ন্ত্রক। দেবীর নামে কাল শব্দের সঙ্গে যুক্ত ঈ-কার। সনাতন ধর্মে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করতে ঈ-কারের সৃষ্টি এবং শব্দোচ্চারণকে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্রোধাম্বিতা, রণরঙ্গিণী, করালবদনী, মহানিশার প্রতীক দেবী কালী সংহারক বেশে প্রলয়বাদন জাগিয়ে তোলেন আর প্রলয়ের শেষে অসীম শান্তিতে ভরে ওঠে ভক্তের মন।

আরও পড়ুনঃ  হার্ডওয়্যার ও লিফট ব্যবসায় ধস

বাংলায় দেবতাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ পূজনীয় দেবতা হচ্ছেন মা কালী বা কালিকা। কালীর বিভিন্ন রূপের বিস্তৃত বিবরণ তন্ত্রসাহিত্যে পাওয়া যায়। যেমন, দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গ্রহকালী, চামুন্ডা, ছিন্নমস্তা। মহাকাল সংহিতায় আবার কালীর নয়টি রূপের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে কালকালী, কামকলাকালী, চন্ডীকালী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বাংলার বিভিন্ন মন্দিরে আনন্দময়ী, ভবতারিণী, ব্রহ্মময়ী, করুণাময়ী, ঢাকেশ্বরী, চট্টেশ্বরী, যশোরেশ্বরী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা করতে দেখা যায়। তবে দিগম্বরী দক্ষিণাকালীর মূর্তিটিই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল বাংলায়। বলা হয়, কালীর ভয়ে দক্ষিণ দিকের অধিপতি যম ভীত হয়ে পলায়ন করেছিলেন বলে কালীর এ রূপের নাম দক্ষিণাকালী।

সাধারণত কালী বা কালিকার চতুর্ভুজা, খড়গ-নরমুন্ডধারী, বরাভয়দায়িনী, মুন্ডমালা বিভূষিতা, লোলজিহ্বা, কৃষ্ণবর্ণ, মুক্তকেশী এবং শিবের বক্ষোপরি দণ্ডায়মান মূর্তিটিই পূজিত হয়ে থাকেন। কারণ, রক্তবীজ অসুরকে বধ করে দেবী কালী যখন প্রলয়নৃত্য শুরু করেন, তখন দেবতাদের অনুরোধে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব দেবীর সামনে শুয়ে পড়েন। তান্ডবনৃত্য করতে করতে মা কালী এক সময় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখেন তিনি তাঁর স্বামীর বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তা দেখে তিনি জিভ কাটেন। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে সেই সময়কার সেই রূপ পূজিত হয়ে আসছে আজও। মা কালীর এ রুদ্রমূর্তিই আমরা প্রত্যক্ষ করি তাঁর সকল রূপে, বিভিন্ন চিত্রকলায় এবং বিভিন্ন মূর্তিতে। এভাবেই মায়ের চিরাচরিত সম্মুখে জিহ্বা বের করা মূর্তি প্রসিদ্ধ লাভ করে পৃথিবীলোকে। কালীপূজা বিশেষভাবে কার্তিক মাসের অমাবশ্যায় মধ্যরাতে অনুষ্ঠিত হলেও সারাবছর ধরে এ পূজা বাঙালি হিন্দুদের ঘরে ঘরে পূজিত হয়ে থাকেন।

আরও পড়ুনঃ  আজকের টপ গেইনার তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

উল্লেখ্য, দীপান্বিতা কালীপূজাই হলো দীপাবলি উৎসব, যা বাংলার বাইরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মহা উৎসবে উদযাপিত হয়ে থাকে। গবেষকদের মতে, দীপান্বিতা বা দীপাবলি উৎসবের কালীপূজার মধ্যরাতের আরাধনার সঙ্গে পরবর্তীকালে আলোকসজ্জা তথা নানা বাজি পোড়ানোর ব্যাপারটা ঐকীভূত হয়ে যায়। ফলে কার্তিক মাসের অমাবশ্যায় কালীপূজা এবং দীপাবলি একসঙ্গে উদযাপিত হতে থাকে।

কালীপূজা এদেশের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সমাজজীবনে বাঙালির দৃষ্টিতে নারী মহামায়ার প্রতীক। দেবী মহামায়া তথা কালী সর্বদাই অসুর বিনাশ করে সৎ মানুষকে রক্ষা করেন এবং মন্দকে ধ্বংস করেন। আমাদের মঙ্গল এবং কল্যাণের জন্যই মা কালী উগ্র ও ভয়ঙ্করী। সুতরাং তাঁর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাই এবং সাধক রামপ্রসাদের সুরে বলি, ‘ডুব দেরে মন কালী বলে, হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।’

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন