শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সম্ভাবনা বাস্তবায়নে ঢিমেতাল

সম্ভাবনা বাস্তবায়নে ঢিমেতাল

বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের ভাবনায় সময় খরচ করলেও দেশীয় পর্যটকরা পাড়ি জমাচ্ছেন নানা দেশে। অবকঠামোর অভাব, যোগাযোগের অব্যবস্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধা না থাকার ফলে দেশি পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, পদে পদে প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদেশি পর্যটকেরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। ভিসা ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারণে তারা কম আসছেন। অথচ বিশ্বের ১০ শতংশ জাতীয় আয় এ খাত থেকে আসার অপার সম্ভাবনা ছিল। এসব মূল্যায়ন করেছেন বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতি ও পর্যটন শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিত বক্তারা।

গতকাল বুধবার রাজধানী ঢাকার প্যান পেসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউসার আহাম্মদ। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী এমপি।

মূলপ্রবন্ধে ড. মো. কাউসার আহাম্মদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে সমুদ্রবিষয়ক এ্যাক্ট তৈরি করেন ও এটি সংসদে পাস হয়। অথচ জাতিসংঘে সমুদ্রবিষয়ক আইন করেছে ১৯৮০ সালে। ১০ বছরে ১০০টি ইনোভেশন তৈরি করে ১০০ কোটি মানুষের কাজ তৈরির কথা বলা হচ্ছে বিশ্বের পর্যটনখাতকে ঘিরে।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, সমুদ্র না থাকলে একদিনও বেঁচে থাকা যাবে না। মেরিন ইকোসিস্টেমের দুটি বিষয় লাভ করি। পৃথিবীর সব অক্সিজেন সাগর থেকে আসে। অথচ আমরা সাগরকে, সাগরের সম্পদকে অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করে ধ্বংস করছি। ব্ল-ইকোনোমি নিয়ে কাজ করে আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশ এগিয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে ব্লু ইকোনোমিতে। ইন্দোনেশিয়ার পর্যটনে জিডিপিতে ২২ ভাগ ও চীনের ১০ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। অস্ট্রেলিয়ার ২০৩০ সালের ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার পরিকল্পনা আছে। ২০৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে পর্যটনখাতে।

প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ভারত দেখিয়েছে তাদের সমুদ্রের অংশে হাইড্রেট আছে ৯০০ টিসিএফ ও সেখান থেকে তুলতে পারবে ৩০০ টিসিএফ। সমুদ্র পরিবহন ২০৫০ সালে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া বিশেষভাবে কাজ করবে। এ পথে জাহাজে পণ্য রপ্তানিতে বিপুল সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশে ১২টি কোম্পানির ৮০টি জাহাজ আছে। যা পণ্য আনানেয়ায় কাজ করে থাকে। আর এ অঞ্চল দিয়ে ২৫০০ হাজার জাহাজ যাতায়াত করে থাকে। আমাদের বে-টার্মিনাল ও চট্টগ্রাম বন্দরে ৯০ শতাংশ কাজ করা যাবে।

আরও পড়ুনঃ  বুলবুলের তাণ্ডবে পাঁচজনের মৃত্যু

আরও উল্লেখ করা হয়, ভারত মহাসাগরে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বিগ বি আসিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে। মেরিন স্পেশাল প্ল্যান না করলে রাস্তার মতো সমুদ্রে জ্যাম লাগবে ১০ বছর পরে। ব্লু-ইকোনোমি নিয়ে দেশের ১৬টি মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে কাজ করে। আর একটি সেল আছে সেটিও ভালোভাবে কাজ করছে না। উভয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার।

মূলপ্রবন্ধে ড. মো. কাউসার আহাম্মদ তথ্য তুলে ধরে বলেন, দেশে ২০৩৫ সালে বিদেশি পর্যটক আসবে ৬০ মিলিয়ন। ২০২০ সালে ১.৫৬ মিলিয়ন ছিল আর ২০৩০ সালে ৫ মিলিয়ন হবে। আমাদের দেশে দেড়শ দ্বীপ আছে। এগুলোকে পর্যটনবান্ধব করা গেলে বিপুল সংখ্যক বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব।

বৈঠকে পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, ভিসার সিস্টেম থাকলে হয়তো সাইবেরিয়া থেকে পাখি আসতো না। পরিবেশ ভালো থাকার কারণে পাখি আসছে। এখানে বিদেশিদের খাদ্য ও চাহিদা পূরণ হয় না। বিদেশি পর্যটকের আশায় বসে থাকলেও প্রতি পদে পদে বাধার কারণে দেশীয় পর্যটক চলে যাচ্ছেন বিদেশে। সেন্টমার্টিন রাখতে হবে। সোনাদ্বীপ, কুতুবদিয়া, সন্দ্বিপসহ অন্যান দ্বীপগুলোকে রক্ষা করতে হবে। সন্দ্বীপে পর্যটকদের যেতে ব্যবস্থাও নেই। আমাদের মহেশখালী ও কুতুবদীয়া মিনি সুন্দরবন।

মন্ত্রী বলেন, হাতিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো অথচ পর্যটক নেয়ার ব্যবস্থা নেই। ট্যাক্সের কারণে পর্যটক আসছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এক্ষেত্রে সহজ নীতি করতে হবে। আমাদের ভৌগলিক দিক ভালো। দেশ থেকে প্রচুর পর্যটক ভারতে যায় কিন্তু ভারত থেকে আসে না ভিসার কারণে। চীনের জন্য ভিসা সহজ করতে হবে। তিনি বলেন, পর্যটক আনতে হলে ভিসা পদ্ধতি সহজ করতে হবে। রিজিওনাল কো-অপারেশন করা দরকার। সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশও অনেক কিছু সহজ করছে। শুধু বড় বড় বিল্ডিংই পর্যটন নয়।

পর্যটন প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু এটিকে পর্যটনে সুইজারল্যান্ড বানাতে চেয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশ্বে সম্ভাবনায় জায়গা। পর্যটন সামাল দিতে পারবেন না। ক্রু-সিড আসবে। তাদের জন্য সহজ করতে হবে। প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। সেন্টমার্টিনের পর্যটক অন্যদিকে নেয়া যায় কীভাবে তা চিন্তা করতে হবে। কক্সবাজারে বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। চট্টগ্রামে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  হারিয়ে যাচ্ছে লাঙ্গল-জোয়াল

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদেশিদের প্রথমেই আমরা আসামি ভাবি। এটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সমাজের কত শতাংশ মানুষ ব্লু-ইকোনো শব্দের সাথে পরিচিত? মানুষকে ভালোভাবে বুঝাতে পারলে পর্যটক আসবে। আশপাশের দেশও আমাদের মাছ ধরে নিয়ে চলে যায়। বিদেশি পর্যটক যাতে আসে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, সমুদ্রের ৩টি স্তর রয়েছে সম্পদ তথা পর্যটনের। ১. পানির মধ্যে ২. পানির নিচে সমুদ্রের নিচে পানির পরে। পানির নিচে শুধু মৎস আহরণ নয়। এখানে পর্যটনের কাজ আছে। অনেকেই মাছ ধরতে ও দেখতে চায়। সমুদ্রের নিচের সম্ভাবনা তথা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করা যায়। সেখানেও অনেক লোক দেখতে যাবে। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। সেখানে পর্যটনের জায়গা নিয়ে চিন্তা করা হবে। শুধু আন্তর্জাতিক নয় স্থানীয় পর্যটকদের নিয়েও চিন্তা করতে হবে। 

মো. মোকাম্মেল হোসেনের বলেন, এ বছর মুজিবস বাংলাদেশ হচ্ছে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং। জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এটি করা হয়ে। বিশ্বের পর্যটনের অবদান জাতীয় সম্পদে ১০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে মাত্র ৩ শতাংশ। পর্যটনে অবকাঠামো ও মানবিক সমস্যা রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা শেষ হবে। দেশব্যাপী ১০৫১টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫০টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে জেটি করতে হলে দরকার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। এভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যৌথ বাস্তবায়ন এখানে কাজ করতে হবে। পর্যটনের মাধ্যমে দেশকে উন্নত করা যাবে। পর্যটনে ব্লু-ইকোনোমি করতে হলে পরিবেশসহ অন্যান্য বিষয়গুলোও খেয়াল রাখতে হবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, উন্নয়ন কাজে পরিবেশের ক্ষতি করার পরবর্তীতে চিন্তা না করে বরং প্রথমেই পরিকল্পনা নেয়ার ক্ষেত্রে ভাবতে হবে। সাগর থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ মাছ ধরে। আর সুন্দরবন থেকে জীবিকা লাভ করে ৩৫ লাখ মানুষ। জাতিসংঘের হিসেবে বিশ্বে ১০ লাখ প্রজাতি হুমকির মুখে। আন্তর্জাতিক এলাইনগুলো রক্ষা করতে হবে। হাঙরের স্যুপও অনেক দেশে দামি। এ জন্য আমাদের হাঙর শিকার হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইকোলোজিক্যাল সার্ভিসে দৃষ্টি দিয়ে কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  করোনা সন্দেহে দুদক পরিচালকের মৃত্যু, স্ত্রী-সন্তান আইসোলেশনে

ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, বিশ্বের ৩০ ভাগ কার্বন সাগর শুষে নেয়। প্লাস্টিক চলে যাচ্ছে সমুদ্রে, এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অনেক মাছ ও প্রাণির মধ্যে প্লাস্টিক ঢুকে যাচ্ছে। সেন্টমার্টিনে প্রচুর পর্যটক যাওয়ার কারণে কচ্ছপের ডিম পাড়া বন্ধ হয়ে গেছে ১০ বছর ধরে। এজন্য পর্যটকদের অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। ইকোলজক্যাল ক্ষতির কারণে তাদের কাছ থেকে জরিমানা নিতে হবে। যাতে তারা কোনো ক্ষতি না করে। কয়েক বছরে বাঘের ১০৬-১১৪টি প্রজনন হয়েছে। মানুষের কারণে বাঘও অস্তিত্ব হারাচ্ছে।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে খেয়াল রেখে দায়িত্বশীল পর্যটনশিল্পের বিকাশ হতে হবে। ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোকে সমন্বয় করে পর্যটনের আওতায় আনতে হবে।

সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বে ৩-৫ বিলিয়ন পর্যটক রয়েছে, পানিপথে আমদানি-রপ্তানির ৮০ ভাগ হয়ে থাকে পৃথিবীতে। ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯০০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। সমুদ্রখাতে অর্থনৈতিক বিকাশে ৯টি খাত নির্ধারণ করেছে সরকার। সমুদ্রে পর্যটন দুই ধরনের হয়ে থাকে ১. কোস্টাল ও ২. মেরিন টুরিজম। ইউরোপের ৬০ ভাগ মানুষ কোস্টাল পর্যটন পছন্দ করে থাকে।

ভিসা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, দেশে বর্তমানে ৩৩টি ক্যাটাগরিতে ভিসা দেয়া হয়। পর্যটকদের এক মাসের ভিসা দেয়া হয়। অনারেবল ভিসা দেয়া হয়। দেয়া হয় ৩ মাসের ভিসাও। নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়। ক্রু-সিড বঙ্গোসাগর দিয়ে ভারত, সিঙ্গাপুর-শ্রীলঙ্কা মিলে কাজ করা যেতে পারে। ভিসার ক্ষেত্রে পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ কয়েকটি দেশে এসবি রিপোর্ট নিতে হয়। তা ছাড়া বাকি সবগুলো দেশকে সহজেই ভিসা দেয়া হয়। ই-ভিসা সম্পর্কে আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, ১৮ অক্টোর বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ই-ভিসা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আবেদন করে ভিসা পাবেন পর্যটকরা।

সংবাদটি শেয়ার করুন