রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কর্মসংস্থানের অর্ধেকই ঢাকায়

কর্মসংস্থানের অর্ধেকই ঢাকায়

দেশের রাজধানী শহর বৃহত্তর ঢাকা দেশের জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ এবং আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের প্রায় অর্ধেক উৎপন্ন করে থাকে। জলবায়ু অভিবাসীদের সমস্যা সমাধানের জন্য ইতোমধ্যেই ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী প্রস্তুত করা দরকার বলে প্রস্তাব করেছে বিশ্ব ব্যাংক। ‘লঞ্চ অব দ্যা বাংলাদেশ কান্ট্রি ইকোনোমিক মেমোরান্ডাম’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানী ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রতিবেদনটি প্রকাশে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের এক্টিং ডিরেক্টর ড্যান্ড্যান চেনের শুভেচ্ছা বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হয়। এতে মূলপ্রবন্ধ তুলে ধরেন সিনিয়র ইকোনোমিস্ট নোরা দিহেল, বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনোমিস্ট কন্সালটেন্ট ড. জাহিদ হোসেন। উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সানেমের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর প্রফেসর সেলিম রায়হান, এসবিকে টিচ ভেঞ্চার্স এন্ড এসবিএকে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া বশির। বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের লিড ইকোনোমিস্ট ইউতাকা উশিনোর সঞ্চালনায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন মাইক্রোইকোনোমিকস, ট্রেড, ইনভেস্টমেন্ট এন্ড পাবলিক সেক্টরের দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্টিস ম্যানেজার হোন এস সোহ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান গ্রোস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট-জিডিপি হচ্ছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এই অবস্থা চলতে থাকলে এটি ক্রমেই নিচের দিকে যাবে। ২০২১ থেকে ২৫ সাল পর্যন্ত গড়ে এটি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ থাকবে। ২০২৬-৩০ সালের মধ্যে আরো কমে ৬ দশমিক শূন্য শতাংশে আসবে। ২০৩১ থেকে ৩৫ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এমনকি ২০৩৬-৪১ সালে এটি ৫দশমিক শূন্য শতাংশে নেমে আসবে। তবে মডারেট রিফোর্ম অর্থাৎ আর কিছুটা ভালোভাবে গেলে ২০২১ থেকে ২৫ সাল পর্যন্ত গড়ে এটি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। ২০২৬-৩০ সালের মধ্যে আরো ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০৩১ থেকে ৩৫ সালে ৬ দশমিক ২ শতাংশ এমনকি ২০৩৬-৪১ সালে এটি  ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

স্ট্রং রিফোর্ম অর্থাৎ অর্থনীতির চাকা আরো শক্তিশালী হলে ২০২১ থেকে ২৫ সাল পর্যন্ত গড়ে এটি ৭  দশমিক শূন্য শতাংশ। ২০২৬-৩০ সালের মধ্যে আরো ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০৩১ থেকে ৩৫ সালে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এমনকি ২০৩৬-৪১ সালে এটি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে।

আরও পড়ুনঃ  টপটেন গেইনারে শতভাগ, লুজারে ৬০ শতাংশ

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বন্ধুত্বের বার্তা শক্তিশালী। বিশ্ব ব্যাংকের কিছু প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করতে পারি। তারমধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, ব্যাংকিং সেক্টরকে গতিশীল করতেও কিছু কাজ করা প্রয়োজন যদিও এখানে কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন আছে। বর্তমান সরকারের আমলে সার্বিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। খাদ্য মজুদ বাড়ছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি চাপ আছে এটি সত্যি কথা। রাজনৈতিক সংঘর্ষের বিষয়টি লুকানোর কিছু নেই। এই ষড়যন্ত্র কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়। আলোচনা, সভ্যতা-ভব্যতার মধ্যে আসতে হবে। আলোচনায় বসতে হবে। মন্ত্রী বলেন, আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঘাটতি প্রচুর। অর্থাৎ এক টাকা রপ্তানি করলে আমদানি করতে হয় ১০ টাকা। এখানে ৯টাকা ঘাটতি থাকছে। এসব ঘাটতি কমাতে আমাদের পণ্য সেসব দেশকে নেয়ার প্রস্তাব দিলে তারা অনেক সময় না করে দেয়। এক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঘাটতি কমাতে রাজনৈতিকভাবে বসে কথা বলা প্রয়োজন। শক্তিশালী বাণিজ্য প্রতিযোগিতা, আর্থিকখাত এবং ভালো-কার্যকর শহরগুলি হলো বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অগ্রগতি করেছে। এই প্রবৃদ্ধির গতিপথ ধরে রাখতে এবং দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধির হারকে আরও ত্বরান্বিত করতে, দেশটির একটি শক্তিশালী সংস্কার এজেন্ডা প্রয়োজন বলে বিশ্বব্যাংকের একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম-চেঞ্জ অফ ফেব্রিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূল বাধা চিহ্নিত করে এবং দ্রুত প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য কার্যকরী সংস্কারের প্রস্তাব করে।

প্রতিবেদনে তিনটি শক্তিশালী নীতি সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে। যা প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। তারমধ্যে রয়েছে ১. বাণিজ্য প্রতিযোগিতার ক্ষয় রোধ করা, ২. আর্থিকখাতে দুর্বলতা মোকাবিলা করা এবং ৩. সুশৃঙ্খল নগরায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। প্রতিবেদনটি এই সংস্কার এলাকায় ক্রস-কাটিং থিম হিসাবে ডিজিটাল উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলিও  খোঁজে। গত এক দশকে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ড্যান্ডান চেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। নতুন এবং উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলোসহ, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন-একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির পরিবর্তনশীল মনোযোগের জন্য নতুন নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবনের দাবি রাখে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের রূপকল্প অর্জনের জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী এবং রূপান্তরমূলক নীতি পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে।

আরও পড়ুনঃ  দেশে আজও করোনায় মৃত্যু শূন্য, কমেছে শনাক্ত

প্রতিবেদনে রপ্তানি অস্থিরতার ঝুঁকি কমাতে, প্রবৃদ্ধির নতুন উৎস তৈরি করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলা হয়েছে। তৈরি পোশাকের উপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষামূলক শুল্ক ব্যবস্থা বৈচিত্র্যময় রপ্তানি বৃদ্ধির পথে বাধা। অধিকন্তু কম মজুরি এবং বাণিজ্য পছন্দের উপর ভিত্তি করে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সাথে দেশটি তার রপ্তানি ঝুড়িকে বৈচিত্র্যময় করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে পারে।

বাংলাদেশে গড় শুল্ক তার তুলনাকারী দেশগুলির তুলনায় বেশি: বাংলাদেশে মধ্যবর্তী পণ্যের গড় শুল্ক হার ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ, যা চীন, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সামগ্রিক বাণিজ্য ব্যয় এবং অদক্ষ সীমান্ত প্রক্রিয়া বাণিজ্যে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতের সাথে শুল্ক আধুনিকীকরণ, বর্ধিত বাণিজ্য সহজীকরণ, পরিষেবা এবং বিনিয়োগ সংস্কারের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য চুক্তি যথাক্রমে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি করতে পারে। এটি শূন্য দশমিক ৪ ও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং রপ্তানি ১ দশমিক ৪ ও ৩ দমমিক ৯ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য বেসরকারিখাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। সম্পদের গুণমান উন্নত করা, ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান নন-পারফর্মিং লোন মোকাবিলা করা, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং ঋণ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য জরুরিভাবে প্রয়োজন। থাইল্যান্ড, চীন এবং ভিয়েতনামের বিপরীতে বাংলাদেশের একটি অপ্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজার রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। অর্থ, বিশেষ করে অবকাঠামো এবং জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পের জন্য। সবুজ বিনিয়োগ এবং জলবায়ু ঝুঁকিতে অর্থায়নের জন্য বেসরকারিখাতের অর্থায়ন মুক্ত করা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুনঃ  ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে যা জানাল আবহাওয়া অফিস

বিশ্ব ব্যাংক জানায়, নারী এবং এমএসএমই-এর মতো সুবিধাবঞ্চিত অংশগুলিতে অর্থের সম্প্রসারণের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারের মাধ্যমে, স্থানীয় মুদ্রায় অর্থায়নের প্রচারের মাধ্যমে, বহিরাগত ঋণের সীমাবদ্ধতা সহজ করে এবং আকর্ষণ করার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে বহিরাগত সম্পদের উৎস করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ, যদিও ২০১৪ সালের ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ২০১৭ সালে ৩৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কদের ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবহার করে পেমেন্টের ডিজিটালাইজেশন দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কদের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। ক্রেডিট অবকাঠামো শক্তিশালী করা এবং আর্থিক পরিষেবার আরও ডিজিটালাইজেশন প্রয়োজন। এটি সবচেয়ে অনুন্নত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ।

নোরা দিহেল বলেন, উন্নত নগরায়ণ এবং সংযোগ জলবায়ু অভিবাসীদের শুষে নিতে এবং দ্রুত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। সফল নগরায়নের অর্থ হবে ছোট এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আকৃষ্ট করা। মাঝারি আকারের শহরের জন্য পরবর্তী স্তরের শহরগুলোকে আনুষ্ঠানিক সংস্থা এবং দক্ষ কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনসহ অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং পরিষেবার বিধানের জন্য শহরগুলিকে তাদের নিজস্ব রাজস্ব বাড়াতে হবে। দ্রুত ব্রডব্যান্ড গতি, মৌলিক পরিষেবাগুলিতে আরও ভাল অ্যাক্সেস এবং সহজ আন্তঃনগর পরিবহন সংযোগ ঢাকার বাইরে নগর বৃদ্ধিকে উন্নীত করার জন্য গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জের মতো শহরে নিয়ে যেতে পারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন