শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভুটান পর্যটনবান্ধব, তবে বাংলাদেশ নয়

ভুটান পর্যটনবান্ধব, তবে বাংলাদেশ নয়

– মো. জাকির উসমান, কর্ণধার, বাংলার যাযাবর

বাংলাদেশের পর্যটনস্থানগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের কারণে। স্থানীয় লোকদের অংশগ্রহণ না থাকায় সেখানে পর্যটকরা গিয়ে সমস্যায় পড়েন। তাতে পর্যটনশিল্প গড়ে উঠার পরিবর্তে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে মনে করেন বাংলার যাযাবর ট্যুরের কর্ণধার মো. জাকির উসমান। দেশে-বিদেশে শতাধিক ট্যুর পরিচালক জাকির সম্প্রতি দৈনিক আনন্দবাজারকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

ভুটানে পর্যটনের বিষয়ে জাকির উসমান বলেন, ভুটানে বিমান ও সড়কপথ দুইভাবে যাওয়া যায়। সড়কপথে গেলে বিমানপথের চেয়ে অর্ধেক ব্যয় কম হয়। এখানে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। চ্যাংড়াবান্ধা-বুড়িমারি সীমান্ত দিয়ে ভারত হয়ে ভুটানে ঢুকতে হয়। ২০১৯ সালে আমরা যখন গিয়েছি তখন প্রতিজনের ১৮-১৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ছিলাম। এখন নতুন করে দেশটির সরকার ১২ গুলহাম অতিরিক্ত চার্জ ধরেছে। তারা কম পর্যটক নেন। একমাত্র জিরো কার্বন উৎপন্নকারী দেশ ভুটান। বিশ্বের সুন্দর ১০টি দেশের একটি ভুটান। পোয়েন সিলিং, থিম্পু, পোনাখা, পারোসহ বিভিন্ন শহরে গিয়েছি। ভুটানে প্রায় সকল স্থাপনা একটি ডিজাইন অনুসরণ করে থাকে। সারা ভুটানের বাড়িঘর এক দেখায় একই রকমের। তবে গ্রামে সামান্য কিছু পার্থক্য আছে।

শহর ও গ্রামীণজীবনের পার্থক্য কেমন? প্রশ্নের জবাবে জাকির উসমান বলেন, শহরের প্রতিটি মানুষ কাজ করে। প্রত্যেকেই পরিশ্রমী। কেউ বেকার নেই। সকলেই কাজ করে। বসে খাওয়ার প্রবণতা তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। অপারগ বা অক্ষম হলে ভিন্ন কথা। শহরের ব্যস্ত জীবনের মধ্যে এক ধরনের নির্মোহতা আছে। কোনো অস্থিরতা ও তাড়াহুড়া নেই। যন্ত্রসভ্যতা থাকলেও দুই দেশের শহরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সেখানে মানবিক দিক বড় করে দেখা হয়। মানুষের জীবনই যে সবচেয়ে বড় সেখানে গেলে এটি উপলব্ধি করা যায়। সেখানে শহরেরও জীবন তথা প্রাণবন্ধতা আছে যা আমাদের এখানে অনুপস্থিত। আমাদের শহরের প্রাণবন্ধতা নেই। সবকিছুতেই অস্থিরতা ও তাড়াহুড়া। শহরের অনেক বাইরে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অর্থের ও সচ্ছলতা কম। চীন সীমান্তের দিকে চেলেলাপাস এলাকায় গেলাম। ১৪ হাজার ফুট ওপরে। সেখানে অনেক গ্রাম ও শহর দেখলাম। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলছে।

আরও পড়ুনঃ  সুনামগঞ্জে নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৃত্তি চেক প্রদান

বাংলাদেশ-ভুটানের পর্যটন পার্থক্য কেমন? জানতে চাইলে বাংলার যাযাবর ট্যুরের কর্ণধার বলেন, ভুটান পর্যটনবান্ধব দেশ। আর বাংলাদেশ কোনোভাবেই পর্যটনবান্ধব দেশ নয়। কেননা বাংলাদেশে যেখানেই পর্যটন স্থান গড়ে উঠে সেখানেই সিন্ডিকেট। নেই সরকারের সহযোগিতা, না আছে স্থানীয় সরকার ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা। আমার মনে হয় বাংলাদেশে যে পর্যটনস্থানগুলো আছে সেখানকার লোকদের সম্পৃক্ত করে প্রশিক্ষণ দিয়ে বোঝানো এটি শিল্প ও কর্মসংস্থানের জায়গা।

ভুটান আর বাংলাদেশের পর্যটনের তুলনামূলক দিক তুলে ধরে জাকির উসমান বলেন, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটে গেলে সেখানে থাকা-খাওয়া চলে যাবে ১০ হাজার টাকার ওপরে। অথচ এই টাকায় মেঘালয় ও আসাম ঘুরে আসা যায়। কেননা বাংলাদেশে হোটেল-মোটেল, ট্রান্সপোর্টসহ সব জায়গায় অতিরিক্ত অর্থ নেয়া হয়। এসব পরিবর্তন না হলে পর্যটনশিল্প এগোবে না।

বাইরের লোক গিয়ে পর্যটনশিল্প গড়ে তুলছে অর্থাৎ স্থানীয় লোকদের সম্পৃক্ততা নেই। কর্মসংস্থান নেই। এতে করে স্থানীয় মানুষজন এটিকে সম্পদের পরিবর্তে বোঝা মনে করছে। এ থেকে বের হয়ে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা যায় কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে জাকির উসমান বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার। তাছাড়া কয়েকটি বন ও চর এলাকায় দেখেছি স্থানীয় লোকজন নিজেরা কাজ করছে। এটির রক্ষণা-বেক্ষণ করছে। পর্যটকদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতে হবে। গত ১০ বছরে পর্যটনটি বাংলাদেশে ব্যবসায় দাঁড়ালেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পর্যটন করপোরেশন অনেক কাজ করলেও মূল কাজটি করছে না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করছে না। দেখুন, সিলেটে অন্য জেলার লোক গেলে ১০০ টাকার ভাড়া ৪০০ টাকা নেয়া হয়। এই অবস্থা দেশের অনেক জায়গাতেই। তাহলে পর্যটক কেন যাবে? বান্দরবানের থানচিতে এর ব্যতিক্রম। সেখানে সেনাবাহিনী সহযোগিতা করে থাকে। তারা চাঁন্দের গাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  সৈয়দপুরে জনাসমাগম রোধে প্রশাসনের অভিযান

ভুটানে বৌদ্ধধর্মালম্বী ও সংস্কৃতির কী অবস্থা? জানতে চাইলে জাকির উসমান বলেন, দেশটি বৌদ্ধধর্মালম্বী হলেও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি কিছুই নেই। তারা কাজকেই ধর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছে। সবাই নিজ নিজ মতো ধর্ম পালন করছে।  

বাংলাদেশের পর্যটনব্যবস্থা কেমন হওয়া দরকার? প্রশ্নের জবাবে জাকির উসমান বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ তাই নদীকে ঘিরে পর্যটনশিল্প গড়ে উঠা দরকার ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে নদীমাতৃক পর্যটন এখানে গড়ে উঠেনি। কোনো পর্যটনস্থান আবিষ্কার হলে কয়েক বছরের মধ্যেই ময়লা-আবর্জনা ও অব্যবস্থাপনায় তা ধ্বংস করে ফেলা হয়। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা বাংলার যাযাবর থেকে আমি শতাধিক ট্যুর পরিচালনা করেছি দেশে-বিদেশে। আমার কাছে মনে হয়, পর্যটনশিল্পকে বিকশিত করতে স্থান লোকদের গুরুত্ব দিতেই হব। প্লাস্টিকসহ অপচনশীল পণ্য, ময়লা-আবর্জনা ফেলে যাতে এসব স্থান নষ্ট না করা হয় সেক্ষেত্রে সবার সচেতনতা লাগবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন