- অতিথিরা এলেও নাকে হাত দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন
- শেরার খালে কারখানা বর্জ্য অপসারণের ড্রেন
শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের বাউনী গ্রামের শেরার খালে কারখানা বর্জ্য অপসারণের ড্রেন নির্মাণ চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ভেক্যু দিয়ে ড্রেন নির্মাণ করে তা ওই খালে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সরেজমিন বাউনী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় প্যারাগন পোল্ট্রি খামার থেকে আবাদি জমির পাশ দিয়ে কমপক্ষে ১০ ফুট প্রশস্ত ও ২০ ফুট গভীরতা পরিমাপে ড্রেন খননের কাজ চলছে। ড্রেনটি কোথাও ব্যক্তিমালিকানা আবার কোথাও বনবিভাগের জমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত করার কাজ চলছে। প্যারাগন পোল্ট্রি কারখানা থেকে শেরার খাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে কমপক্ষে ১০ ফুট ব্যাসার্ধ ও ১০ ফুট দৈর্ঘ্যরে শতাধিক রিং ফেলা হয়েছে। শেরার খালে মাছ ধরার কয়েকটি জাল দেখা গেছে। প্রতিদিন ওই খালে প্রাকৃতিক মাছ ধরা হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, স্থানীয় এক ব্যক্তি লোকজন নিয়ে প্যারাগন কারখানার বর্জ্য অপসারণের জন্য চলতি আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ড্রেন নির্মাণের উদ্বোধন করেন। সরকারি উদ্যোগে এ কাজটি করা হচ্ছে বলে স্থানীয়দের জানান। এরপর থেকে জোতদারদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে ভেক্যু দিয়ে গর্ত করে জোরপূর্বক ড্রেন নির্মাণের কাজ চালানো হচ্ছে। তাদের তৎপরতায় অনেক চাষী ভয়ে কিছু বলার সাহস পায় না। “সরকারি উদ্যোগে ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে” প্রচার দিয়ে জোর করে চাষিদের জমির ওপর দিয়ে ড্রেন নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে প্যারাগন পোল্ট্রি কারখানার বর্জ্যরে দুর্গন্ধে এলাকার মানুষ ভুগছে। কারখানা থেকে বেশিরভাগ পোল্ট্রি বর্জ্য ট্রাকে করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। মাঝে মধ্যে মৃত মুরগীর পঁচা দুর্গন্ধে আশপাশের মানুষের জীবন জীবিকা থেমে থাকে।
স্থানীয় পোশাক শ্রমিক মরিয়ম বেগম বলেন, জোর করে ব্যক্তি মালিকানা জমির ওপর দিয়ে ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। শেরার খাল পর্যন্ত ড্রেনটি প্রবাহিত করতে হলে সরকারি জমিও যাবে। আগে ট্রাক দিয়ে প্যারাগন কারখানার বর্জ্য অন্যত্র নিয়ে ফেলা হতো। এখন ড্রেন নির্মাণের চেষ্টা করছে। আমার সামান্য জায়গায় ড্রেনের রিং ফেললে আমার ভিটেমাটির অবশিষ্ট কিছু থাকবে না। মশা-মাছি, পোকা-মাকড়ের কারণে স্থানীয়রা প্যারাগন কারখানার গেট অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তারা “সরকারি উদ্যোগে ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে বলে” প্রচার দেওয়ায় এলাকার সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।
কৃষক আব্দুল হামিদ বলেন, শেরার খালের পানি দিয়ে এলাকার চাষিরা বোরো ফসল করেন। বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরেন। ড্রেন নির্মাণ করে বর্জ্য ফেলা হলে শেরার খালে মাছ থাকবে না, কৃষি কাজও হবে না। খালটিতে প্রতিদিন স্থানীয়রা প্রাকৃতিক মাছ আহরণ করেন।
গৃহিণী হালিমা খাতুন বলেন, প্যারাগন কারখানার মুরগীর বর্জ্যের গন্ধে বাড়িতে খেতেও পারেন না। গবাদি পশু চড়াতে পারেন না। সার্বক্ষণিক নাক-মুখে রুমাল চেপে চলাফেরা করতে হয়। নারী-শিশুসহ সকলের গায়ে নানা ধরণের চর্মরোগ লেগেই থাকে। কারখানার দুই পাশে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত বর্ষণে বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি আবাদি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে ফসল নষ্ট হয়।
ওসমান গণি জানান, প্যারাগনের দূষিত বর্জ্যের কারণে এলাকায় কারও বাড়িতে গত কয়েক বছর যাবত মেহমান আসেন না। আত্মীয়তা করতে গেলে একবার কেউ এসে ঘুরে গেলে আর এ গ্রামে আসতে চায় না। প্যারাগনের বর্জ্যের গন্ধে ও পানি দূষিত হওয়ায় জমিতে আগে যেখানে ২০ মন ধাণ পাওয়া যেত এখন ৩ মণ পাওয়া যায়। বর্জ্যের কারণে জমিতে পোকা হয়, ধানের চারার মূল কেটে দেয়। ধানের এসব ন্যাড়া গবাদিপশু খায় না। এলাকার অনেক মানুষ সারা বছর অসুস্থ থাকে। প্যারাগনের পক্ষে স্থানীয় এক ব্যক্তি লোকজন নিয়ে সরকারি শেরার খালে বর্জ্য সরিয়ে নেওয়ার জন্য রিং ফেলছে।
কৃষক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, বর্ষাকালে প্যারাগন কারখানার বর্জ্য মিশ্রিত পানি খালে নামে। এসময় খালের পানিতে হাঁস নামলে কিছুক্ষণ পরে মারা যায়। পানিতে মানুষের পায়ে ঘা হয়। খালে ওযু, গোসল করা যায় না।
স্থানীয় যুবক সায়েম জানান, শ্রীপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গত ২২ আগস্ট জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। এক ফোঁটা বর্জ্য যেন শেরার খালে না পড়ে সেজন্য সকলকে হুঁশিয়ার করে গেছেন। তারপরও চক্রটি অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তৎপরতা চালাচ্ছে।
এসব বিষয়ে স্থানীয় অভিযুক্ত শফিকুল ইসলাম নিজেকে পরিবেশবাদী আন্দোলনের কর্মী পরিচয়ে বলেন, তিনি প্যারাগনের সঙ্গে কোনো কাজে জড়িত না। এ ব্যাপারে প্যারাগনকে কোনো সহযোগিতাও করছেন না। প
রিবেশ অধিদপ্তর থেকে এনফোর্সমেন্টের লোকজন এসে যেভাবে দেখিয়ে গেছেন সেভাবে কাজ করছে কিনা প্যারাগন কর্তৃপক্ষ তাকে তা দেখতে বলেছিলেন। কাউকে কোনো চাপ বা সরকারি কাজের মিথ্যা তথ্য প্রচারের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
প্যারাগন পোল্ট্রি খামারের ব্যবস্থাপক শাহীন বলেন, ড্রেন নির্মাণের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। কেউ তার নাম বলে থাকলে ভুল বলেছেন।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর কাউকে প্রাকৃতিক পানির প্রবাহে বাধাদান বা খালে বর্জ্য ফেলার পরামর্শ দেয়নি। কেউ পরিবেশ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আনন্দবাজার/শহক