শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানবপাচারে ভয়ঙ্কর বিস্ময়

মানবপাচারে ভয়ঙ্কর বিস্ময়

বিশ্বে বছরে আড়াই কোটি পাচার

আর্থিক লেনদেন ১৫ হাজার কোটি ডলার

টার্গেট

  • ১৬-২০ বয়সী মেয়েরা
  • ১০ বছরে মামলা ৬৫২০
  • মামলা নিষ্পত্তির হার ১১
  • সাজার হার ২ শতাংশ

বিশ্বে প্রতিবছর আড়াই কোটি ব্যক্তি মানব পাচারের শিকার হয়ে থাকে। এতে বার্ষিক লেনদেন হয় ১৫ হাজার কোটি ডলারের। আর শুধু ২০২২ সালের ছয় মাসে ১২ হাজার ৬৩৬ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছে। ভূমধ্যসগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় বাংলাদেশ তালিকায় তৃতীয়। আর গত একযুগে অনিয়মিতভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে ৬৫ হাজার বাঙালি। এই পাচারের ক্ষেত্রেও সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যাবহৃত হচ্ছে। বিশেষত ফেসবুকে লিবিয়া টু ইতালি নামে একাধিক গ্রুপ স্বক্রীয় রয়েছে বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের সহায়তায় পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানিয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নারী ও শিশু পাচার দমনে কাজ করতে গিয়ে গবেষণাটি করেছেন। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে লোক পাঠানো কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নারী ও শিশু পাচার; সব ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাচারকারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা পরিবারের শিশু-কিশোরীদের পাচারের প্রধান টার্গেট। গত কয়েক বছরে পাচারের ক্ষেত্রে ফেসবুক, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম অনেক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চাকরি কিংবা নায়িকা বা মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই মানব পাচারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে চিহ্নিত, নিয়ন্ত্রণ ও তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে অপরাধীচক্র এখন প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিয়ে ও অন্যান্য নিপীড়নের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে শিশুদের লক্ষ্য বস্তু বানানোর হারও দিনে দিনে বাড়ছে।

বিশ্বব্যাপী মানবপাচার বিরোধী দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে গতকাল শনিবার রাজধানী ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কাউন্টার; ট্রাফিকিং ইন পারসন্স টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ (সিটিআইপি-টিডব্লিউজি) অফ বাংলাদেশ ইউএন নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশন (বিডিইউএনএনএম) এর সার্বিক সহযোগীতায় ‘প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর অপব্যবহারের প্রেক্ষাপটে মানব পাচার প্রতিরোধ’ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শ সভার অয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বিশেষ অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রযুক্তির ব্যবহার ও অপব্যবহার’। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই দিনটিকে মানব পাচার দিবস করা হয়।

আরও পড়ুনঃ  ভালুকায় আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে মানববন্ধন

গবেষণা বলা হয়, নারী পাচারের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে গত বছর ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। এ ঘটনায় ভারতের পুলিশ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার মগবাজারের রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়।

এদিকে, ঘটনার পর পুলিশ ও র‌্যাব নারী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি চক্রের ১২ জনকে গ্রেফতার করে। শুধু এই দুই চক্র পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে পুলিশ ও র‌্যাবের দাবি। ভারতে পাচার হওয়া প্রায় ২ হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম পাচারের শিকার ৬৭৫ জন নারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ১৬ থেকে ২০ বছরের কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার। এরপরেই আছে ১১ থেকে ১৫ বছরের কিশোরীরা।

পাচারের শিকারদের একজন যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌরসভার ধোপাদী গ্রামের মেয়ে রুপা (ছদ্মনাম) জানান, ২০১৩ সালে এক নিকটাত্মীয়ের প্ররোচনায়  ভালো জীবন যাপনের আশায় অবৈধভাবে তিনি ভারত যায়। সেখানে মানব পাচারকারী চক্র তাকে মুম্বাইয়ের একটি যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয়। দীর্ঘ চার বছর প্রতিনিয়ত শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে সে অনেক কষ্টে মানসিক অসুস্থতা নিয়ে দেশে ফেরত আসে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর শুধু ওই আইনেই সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মামলারই কোন নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১২-২২ সাল সময়ে ৫৭৩৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। তাতে নারী ৬৮, পুরুষ ২১ ও ১১ শতাংশ শিশু পাচারের শিকার।

মামলা হলেও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা

মানবপাচার প্রতিরোধে সরকার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন করে। এই আইনে ২০১২ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ৫২০ টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দেখা গেছে, ১৩ হাজারেরও বেশি মানুষ পাচারের শিকার। এতে মোট আসামির সংখ্যা সাড়ে ৩১ হাজারেরও বেশি। কিন্তু ৬ হাজার ৫২০টি মামলার মধ্যে গত দশ বছরে মাত্র ৭২৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫০টি মামলায় মাত্র ৯৬ জনের সাজার হয়েছে। বাকিরা অব্যাহতি পেয়ে গেছেন। বাকি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মামলা এখনো চলমান। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির হার ১১ শতাংশ। আর সাজা হয়েছে ২ শতাংশেরও কম।

আরও পড়ুনঃ  ঈদে ছুটি বাড়ছে না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

একযুগে অবৈধপথে ইউরোপে গেছে ৬৫ হাজার মানুষ: ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছে যে দেশগুলোর মানুষ, বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই সেই তালিকায় প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোক সবচেয়ে বেশি।

গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ২ হাজার ২৮৪ জনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্র্যাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এসব জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি লোক এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একেক জন এভাবে ইউরোপে যেতে তিন থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন।

বাংলাদেশ থেকে মোট ১৮টি রুটে লোকজন ইউরোপে যাওয়ার কম-বেশি চেষ্টা করছেন। ইউরোপের সীমান্তে কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্স বলছে, পৃথিবীর যেই দেশ থেকিই আসুক ইউরোপে ঢুকতে হলে শেষ পর‌্যন্ত মোট নয়টি পথ আছে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। এই পথে প্রায় ৩৮ হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে ঢুকেছেন।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, ইউরোপে যাত্রীদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০। অবশ্য শুধু ইউরোপ নয়, করোনা মহামারির মধ্যেও শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার কিংবা ভারতে নারী-কিশোরি পাচার কোনটাই থেমে নেই। বরং এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভিজিট ভিসায় ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা

সাম্প্রতিক সময়ে ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়ে সেখান থেকে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা বেশি দেখা গেছে। গত দুই বছর দেড় থেকে দুই লাখ লোক এভাবে ভিজিট ভিসায় দুবাই গেছে। এদের অনেকেরই এখন কাজ নেই। ফলে অনেকেই ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

আরও পড়ুনঃ  শিক্ষার্থীদের বিশেষ অনুদান : বেড়েছে আবেদনের সময়

ফেরত আসা বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, মানব পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত আছে বাংলাদেশী, পাকিস্তানি, আফগানিস্তানি এবং ইরানিরা বিভিন্ন অঞ্চলের বহু দিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী দালালচক্র। তারা শুরুতে কাউকে টাকা ছাড়াই, কাউকে ৪০-৫০হাজার টাকা আবার কাউকে ২-৩ লাখ টাকার বিনিময়ে গ্রিসে যাবার স্বপ্ন দেখায়।

অন্যদিকে বিদেশে কাজের কথা বলে নেওয়া নারীদের ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন বাড়ছে। গত ছয় বছরে অন্তত ১০-১২ হাজার নারী নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে ছয় হাজার ৬৩৮জন এবং এ বছরের প্রথম ছয় মাসে আড়াই হাজার নারী ফেরত এসেছেন।

২০১৯ সালের ২৬ আগস্টে সৌদি আরব ফেরত ১১০ নারী গৃহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরতে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না। দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রণালয় তাদের ফিরে আসার ১১টি কারণ চিহ্নিত করেছে। ফেরত আসা নারীকর্মীদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ঘাটতি অনেক

মানব পাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানব পাচার রোধে ন্যূনতম যা করা প্রয়োজন, তা পুরোপুরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও শাস্তি প্রদানে সরকারের প্রচেষ্টা বেড়েছে। এ ঘটনায় একজনের সংসদ সদস্য পদ বাতিল বহাল রয়েছে। মানব পাচারের বিচারে ২০২১ সালের আগস্টে সাতটি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে। এ ছাড়া জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) শ্রম কনভেনশনের প্রটোকল অনুসমর্থন করেছে।

আগের বছরের তুলনায় পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সেবায় ঘাটতি রয়েছে।রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর বাড়তি ফি নেওয়ার সুযোগ এখনো রয়েছে। অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠানো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে শ্রমিকেরা পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন