ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংকটেও বড় স্বপ্ন চামড়াখাতে

সংকটেও বড় স্বপ্ন চামড়াখাতে

দেশের চামড়া শিল্পে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। প্রতি বছর শুধুমাত্র কোরবানি ঈদে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ পশুর চামড়ার যোগান দেয় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার টানা দরপতনে ব্যবসায় লোকসান ও ইটিপি (ট্যানারি) স্থাপন করতে না পারায় আসন্ন কোরবানি ঈদ নিয়ে শঙ্কায় সময় পার করছেন নগরের চামড়া ব্যবসায়ীরা। তার উপর লবণের দাম বৃদ্ধি, কোরবানে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অদক্ষতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসসহ মোট আট কারণে চট্টগ্রামে চামড়া খাতের এ সংকট কাটছেই না। পাশাপাশি লোকসানে জর্জরিত হয়ে চট্টগ্রামের অন্তত ৬৭ আড়তদার ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।

মূলত, চট্টগ্রাম থেকে দেশের চামড়া শিল্পের কাঁচামালের বড় যোগান আসে। তবে বছর ঘুরলেও চামড়া ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না। পবিত্র ঈদুল আজহায় কমপ্লায়েন্সের অভাব, ঋণের অভাব, ট্যানারির অভাব, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস, রাসায়নিক দ্রব্য ও লবণের বাড়তি দাম, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে ধীরগতি, প্রণোদনা ঘাটতি, মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দক্ষতার অভাবে চামড়া খাতে সংকট কাটছে না বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

এর মাঝে এবার কোরবানির ঈদে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চট্টগ্রামের চামড়া আড়তদাররা। চট্টগ্রাম শহর ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসব চামড়া সংগ্রহ করা হবে। চামড়া সংগ্রহের মোক্ষম এ সময়ে স্ব-উদ্যোগে ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।

চট্টগ্রামে এক সময় ২২টি ট্যানারি ছিল। লোকসানের কবলে অধিকাংশ মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে রিফ লেদার নামের একটি ট্যানারির উপর ভিত্তি করে চামড়া সংগ্রহ করেন আড়তদাররা। কোরবানের সময় চট্টগ্রামের আড়তদারদের কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারিটি। ফলে আড়তে সংগৃহীত অধিকাংশ চামড়া চট্টগ্রামের বাইরে ট্যানারিতে বিক্রি করতে হয়। এতে অনেক সময় প্রত্যাশিত মূল্য পাওয়া যায় না। এতে করে লোকসানও গুণতে হয় অনেক আড়তদারকে।

চামড়ার আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবছর কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ পিস। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে তিন লাখ। তার বিপরীতে সংগ্রহ করা হয়েছিল মাত্র দুই লাখ। ২০২০ সালে ৪ লাখ ও তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সাড়ে ৩ লাখ কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। চলতি বছর ভালো দাম ও লোকসান পুষিয়ে নেয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পর ঢাকার ট্যানারি মালিকরা যদি চামড়ার ন্যায্য দাম না দেয় তাহলে শুধু লোকসান নয়, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির উপদেষ্টা খোরশেদ আলম বলেন, সরকার চামড়া কেনার জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয় তা লবণযুক্ত। যত বড় চামড়া হোক চট্টগ্রামের চামড়াগুলো ২০ থেকে ২২ ফুটের বেশি ধরা হয় না। ট্যানারি মালিকরা লবণযুক্ত চামড়ার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাদ দিয়ে কেনে। লবণ, কর্মচারি সবমিলিয়ে প্রতি চামড়ায় আমাদের ২শ’ টাকা খরচ পড়ে। সরকার ফুটপ্রতি পুরো চামড়ার রেট দিলেও ট্যানারি মালিকরা কিছু অংশ বাদ দিয়ে কিনলেও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা পুরো চামড়ার দাম চান। কিন্তু আমরাও তো ট্যানারির হাতে ধরা। এটা মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বোঝেন না। তাই তাদের উদ্দেশ্যে বলব, গ্রাম থেকে চামড়া আনতে দেরি হলে লবণ দিয়ে দিতে হবে। এতে করে এই জাতীয় সম্পদটা নষ্ট হবে না।

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন বলেন, আমাদের আগে প্রতিবছরই পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ পিস কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকতো। লবণের দাম ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে ন্যায্যদাম না পাওয়ার কারণে চামড়া খাতে সংকট কাটছে না। ফলে কমেছে লক্ষ্যমাত্রাও। এবছর আমরা সাড়ে তিন থেকে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।

মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন আরও বলেন, লবণের দাম বেড়ে গেছে। আগে ৬শ’ টাকায় লবণ কিনলে এখন কিনতে হচ্ছে এক হাজার টাকায়। প্রতিটি চামড়ায় সাত থেকে আট কেজি লবণ দিতে হয়। গুদাম ভাড়া, মজুরি হিসেব করলে প্রতিটি ২০ ফুটের চামড়ার পেছনে আরো ২শ’ টাকার উপরে খরচ পড়ে। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটে আমাদের ১০ থেকে ১২ টাকা খরচ পড়ে। তাই মৌসুমী ব্যবসায়ীদের বলব, এখন প্রচুর গরম পড়ছে। দ্রুত চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তারা নিজেরাই যদি চামড়ায় লবণ দিয়ে দেয় এবং ছায়াযুক্ত স্থানে রাখে তাহলে চামড়াটা সুরক্ষিত থাকবে। আমরা চাই না তারা লোকসানে পড়ুক।

চামড়া খাতের সংকট নিয়ে তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার যে দর নির্ধারণ করে দেবে আমরা সে দামেই কিনবো। তবে ট্যানারি মালিকরা যদি আমাদের ন্যায্য দাম না দেয় তাহলে আমরা লোকসানে পড়ব। গতবছর ঢাকার এতগুলো ট্যানারির মধ্যে অধিকাংশই আমাদের কাছ থেকে চামড়া নেয়নি। ছোটখাটো দু চারটা ট্যানারির প্রতিনিধি এসে গতবছর আমাদের কাছ থেকে চার হাজার পিস চামড়া কিনেছিল। ট্যানারির মালিকদের প্রতি অনুরোধ তারা যেন চামড়া কেনার সময় ন্যায্য দামটুকু আমাদের দেয়।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা হলো চামড়া খাত। অথচ চট্টগ্রামে এ খাতে একটা নাজুক অবস্থা আমরা লক্ষ্য করছি। চট্টগ্রামে দুটা ট্যানারি চালু ছিল। এরমধ্যে টিকে গ্রুপের ট্যানারিটা চালু আছে। মদিনা ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ২২টার বেশি ট্যানারি ছিল চট্টগ্রামে। এটা কিন্তু চামড়া খাতের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। তাই চামড়া খাতে পরিবর্তন আনতে হলে সবার আগে কমপ্লায়েন্সের দুরাবস্থা দূর করতে হবে। বিশেষ করে ঈদুল আজহায় স্বাস্থ্যকর ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে চামড়া সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি চামড়াখাতের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সমাধানে কাজ করতে হবে।

১৯৪৮ সাল থেকে বন্দর নগর চট্টগ্রামে চামড়া ব্যবসায়ের বিকাশ ঘটে। লাভজনক ব্যবসার মুখ দেখায় চট্টগ্রামে ২২টি ট্যানারি গড়ে ওঠে। কালের বিবর্তনে লোকসান গুণতে গুণতে প্রায় সব ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। বিগত পাঁচবছর আগেও চট্টগ্রামে সফলভাবে দুটি ট্যানারি চালু ছিল। এদের একটি মদিনা ট্যানারি ও অপরটি রিফ লেদার ট্যানারি। এ ট্যানারি দুটি ঢাকার ট্যানারিগুলোর সাথে তুমুল প্রতিযোগিতা দিয়ে আসছিল। কিন্তু বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় পাঁচ বছর আগে সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দেয় মদিনা ট্যানারি। তবে সংকটকালীন সময়েও লড়াই করে টিকে আছে রিফ লেদার নামের একটি ট্যানারি।

চট্টগ্রামে সমিতিভুক্ত আড়তদারের সংখ্যা ছিল ১১২ জন। এর বাইরে আরও অন্তত ১৫০ আড়তদার ছিল। তবে লোকসানে পড়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেন ৬৭ আড়তদার। সবমিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে আছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন