ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঋণনির্ভরতা কমাবে বিনিয়োগ

ঋণনির্ভরতা কমাবে বিনিয়োগ

সরকার ছয়টি চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছে। তবে চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হলেও সমাধানের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। বলা যায়, রোগ চিহ্নিত করতে পারলেও ওষুধ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন, চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভেবেছেন, তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ওষুধ জানা নেই অথবা দিতে পারেননি। আর প্রস্তাবিত বাজেটটিতে সৃজনশীলতা ও সংবেদনশীলতার অভাব রয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে এভাবে মূল্যায়ন করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩ সিপিডির পর্যালোচনা’ শীর্ষক বাজেট প্রতিক্রিয়া অনুষ্ঠানে এসবেই মূল্যায়ন করেছেন বক্তারা। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

মূল পর্যালোচনায় সিপিডি জানায়, রাশিয়া-ইউরোপের যুদ্ধে সারাবিশ্বজুড়েই চলছে ব্যাপক মুদ্রস্ফীতি। যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙেছে নিত্যপণ্যের দাম। সরকারও এ মূল্যস্ফীতিকে আমদানি নির্ভর বলছে। কোন কোন আমদানিকৃত নিত্যপণ্যের মূল্য ৪০-৪৫ শতাংশ বেড়েছে। গত মাসে সরকারি তথ্যমতেই মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.২৯ শতাংশ। এদিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো আভাস না থাকলেও এবং পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির মধ্যেই সামনের অর্থবছরে সরকারের মূল্যস্ফীতি ৫.৫ থাকবে বলে যে প্রাক্কলন করেছে তাকে অবাস্তব বলছে সিপিডি। মূল্যস্ফীতির হিসাবকে আধুনিকায়ন করার পরামর্শ দিয়ে কোন জাদুর কাঠির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে থাকবে সে প্রশ্নও রাখে সংস্থাটি।

বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা আনার সুযোগের চরম বিরোধিতা করছে সংস্থাটি। এ ধরণের সুযোগকে সৎ করদাতাদের স্রেফ চপেটাঘাট বলেও মন্তব্য করেছে সিপিডি। এ সুযোগকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক- তিনভাবেই অগ্রহণযোগ্য বলছে সিপিডি। এ ধরণের সুযোগ টাকা পাচার করতে উৎসাহিত করবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া বিদেশ থেকে এভাবে টাকা দেশে আসবে না বলে জানায় তারা। ৩০ শতাংশ কর যারা দেন তারা যদি বিদেশে পাচার করে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করেন তবে অন্যায় বাড়বে। এ সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসবে বলে প্রত্যাশা করছে সিপিডি।

পোশাকখাতের মতোই সব রপ্তনিমুখী শিল্পে করপোরেট করহার ১২ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার। যেটা আগে ২৫-৩০ শতাংশ ছিল। এতে মধ্য মেয়াদে বিনিয়োগ বাড়তে পারে বলছে সিপিডি। তবে বর্তমানে দরিদ্রদের জন্য এটা কোনো কাজে আসবে না। তাছাড়া কম দামে খোলাবাজারের চাল বিক্রির বাজেট হ্রাস পেয়েছে। এতে গরিব মানুষ সরাসরি আঘাত পাবে বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। তাছাড়া আয়করে কিছুটা ছাড় দেয়ার দাবি করা হলেও তা করা হয়নি। ফলে বাজেটে উদ্যোক্তা, ধনী ও পাচারকারিরা জিতলেও মধ্যবিত্তদের উপেক্ষা করা হয়েছে। তাছাড়া ল্যাপটপের দাম বাড়লে তা মধ্যবিত্ত ও শিক্ষায় প্রভাব ফেলবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

সরকার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে ৫-৬ ব্যাংক ছাড়া বেশিরভাগ ব্যাংকের অবস্থা দুর্বল বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট। লাভের পরিমাণও কমছে ফলে এটাও দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলতে পারে। বৈদেশিক ঋণেও আগামীতে সুদ বাড়বে। ফলে কী করে তা পরিশোধ হবে? হয়তো আগামীতে স্বল্পসুদ ও দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পাওয়া যাবে না এলডিসি উত্তরণের কারণে। উৎপাদনশীল ব্যয় বাড়াতে হবে বলেছে সিপিডি।

সম্পদ সঞ্চালনার বিষয়ে বলা হয়, বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরকে যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় তা তারা বাস্তবায়ন করতে পারে না। গতবারের লক্ষ্যমাত্রার ৩০ হাজার কোটি ঘাটতি রয়েছে। জনপ্রশানে, পরিবহন-যোগাযোগ, কৃষিতে বরাদ্দ বেশি দেয়া হয়েছে। ভর্তুকি জিডিপির ১.৯ শতাংশ। এটি ৯৫-৯৯ হাজার কোটি টাকায় দাড়াবে। এটি অর্থনীতিতে চাপে ফেলবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি কিছুদিনের জন্য হলেও স্থগিত রাখতে হবে। রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিদেশি সাহায্য কতটুকু ব্যবহার করা যাবে তা চিন্তা করতে হবে।

স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কে বলা হয়, কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যখাত চাপে পড়ে যায়। এখানে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর দাবি করা হলেও বাড়েনি। আগের বরাদ্দ বাস্তবায়নের হারও কম। বাজেট ক্রমান্বয়ে কমছে। ১ শতাংশের নিচে বরাদ্দ। এই অবহেলা সুখকর নয়। মাথাপিছু বরাদ্দ কমে গেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়, শিল্প, শ্রম ও কর্মসংস্থান, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়সহ তিনটিতে বরাদ্দে কিছুটা বেড়েছে। যুবকদের জন্য কী রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। আমাদের ২৫ বছর বয়সী যুবক ৫৭ শতাংশ। তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এখানে তাদের জন্য পরিষ্কারভাবে কিছু করা হয়নি। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে তেমন বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন তেমন কিছু নেই। শিশু ৩৪ শতাংশ তাদের জন্য কি থাকছে তার হিসাব নেই।

নারী বাজেটে জিডিপিতে কমেছে। অথচ নারীকে ক্ষমতায় ও অর্থনৈতিক উন্নতির কথা বলা হয়েছে। ২০২৩ প্রস্তাবিত বাজেটে সৃজনশীনতা কম। এখানে প্রাধিকারের খাতে নমনীয় হওয়ার দরকার ছিল। শিক্ষা উপেক্ষিত খাত বলে জানান, ২০১৯-২০ সালে ১.৯ শতাংশ এবার ১.৮শতাংশ। এখানে বরাদ্দ কমেছে। তাছাড়া জ্ঞান অর্জনে বাধা সৃষ্টি করবে ইংলিশ মিডিয়াম করোরোপ। করের বোঝা শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে। আমদানিকৃত বইয়ে ৭৩ শতাংশ কর দিতে হবে। এটি কমাতে হবে। তিন অর্থবছরে শিশুবাজেট কিছু নেই। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা থাকলেও কমেছে। এখানে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ হয়নি। তবে এবারের বাজেট নির্বাচনমুখি হয়নি। কেননা নির্বাচনের আলোকে কিছু ছোট প্রকল্প নেয়া হয়। এবার তা হয়নি বলেও জানানো হয়।

পরিবেশে এ বছরের ০.৩১ শতাংশ থেকে প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জিডিপির ০.০৩৪ শতাংশ। ফলে বরাদ্দ থেকেই গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় বলে মন্তব্য করা হয়। তরুণ, শিশু ও পরিবেশকে উপক্ষো করা হয়েছে বলে মনে করছে সিপিডি। তাছাড়া ২৯টি নিত্যপণ্যে আমদানি শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব করা হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে বাজেটের দিনও সয়াবিনের দাম বেড়েছে। তাই বাজেটে সৃজনশীলতার পাশাপাশি সয়বেদনশীলতার অভাব দেখেছে সিপিডি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন